৩৩ হাজার মামলা ঝুলছে, তিনটিতে বিচারকই নেই

গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ অর্থঋণ আদালতে বিচারক নেই। তৃতীয় আদালতের বিচারক তিনটি আদালতের দায়িত্ব পালন করছেন।

  • তৃতীয় অর্থঋণ আদালতের বিচারক মেহের নিগার নিজের আদালতের পাশাপাশি তিনটি আদালতের দায়িত্বে আছেন।

  • দ্বিতীয় অর্থঋণ আদালতে সর্বাধিক ১২ হাজার ১৪৭টি, তৃতীয় অর্থঋণ আদালতে ঝুলে আছে ১১ হাজার ৭০টি মামলা।

ঢাকার ৪ অর্থঋণ আদালতে ৩৩ হাজার মামলা ঝুলছেফাইল ছবি

১৬ বছর আগে ঋণের ১৮ কোটি টাকা উদ্ধারে গ্রিন অ্যারো ট্যানারি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ঢাকার প্রথম অর্থঋণ আদালতে মামলা করে জনতা ব্যাংক। ১৬ বছর পরও মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ছয় বছর আগে ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ঋণের পাঁচ কোটি টাকা আদায়ে সিটাডল প্রপার্টিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঢাকার দ্বিতীয় অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণের ৯৩ লাখ টাকা আদায়ে জন্য ডিএইচএ ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ দীন ইসলামসহ তিনজনকে বিবাদী করে ঢাকার চতুর্থ অর্থঋণ আদালতে মামলা করেন। এই মামলাও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

এভাবে ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতে আরও ৩৩ হাজার ৮৬২টি মামলা ঝুলে আছে। অথচ চার মাস ধরে তিনট আদালতে কোনো বিচারক নেই। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ অর্থঋণ আদালতের তিন বিচারক যুগ্ম জেলা জজ থেকে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হন। এরপর তাঁদের বদলি করা হয়। এরপর ওই তিন আদালতে নতুন করে বিচারক পদায়ন করা হয়নি। তৃতীয় অর্থঋণ আদালতের বিচারক মেহের নিগার (সূচনা) নিজের আদালতের পাশাপাশি বাকি তিনটি আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন।

এমনিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। সেখানে ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আদালতে বিচারক না থাকায় মামলার জট বাড়ছে। বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
আবদুল করিম, অর্থঋণ আদালতে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী

আইনজীবীরা বলছেন, বিচারক না থাকায় তিনটি আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে থাকা মামলাগুলোয় শুধু তারিখ পড়ছে। মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক কমে গেছে। অর্থঋণ আদালতে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী আবদুল করিম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এমনিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। সেখানে ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ তিনটি আদালতে বিচারক না থাকায় মামলার জট বাড়ছে। বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে যাঁরা পরিশোধ করেন না, তখন ঋণ আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। ব্যাংকসহ বাদীপক্ষের প্রত্যাশা থাকে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হবে এবং ঋণের অর্থ ব্যাংক ফিরে পাবে। তবে মামলা যদি সঠিক সময়ে নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে ব্যাংকের কোটি টাকা কিন্তু আটকে যায়। এতে ব্যাংকসহ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়।

ঢাকার তিনটি অর্থঋণ আদালতে বিচারক না থাকার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব ঢাকার অর্থঋণ আদালতে বিচারক পদায়ন করা হবে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নতুন ভবনের পঞ্চম তলায় ঢাকার প্রথম অর্থঋণ আদালত অবস্থিত। ঢাকার দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ অর্থঋণ আদালতে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পুরোনো ভবনে অবস্থিত। প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ আদালতে বিচারক না থাকায় বিচারাধীন মামলার নথিপত্র তৃতীয় অর্থঋণ আদালতের বিচারকের সামনে তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারীরা।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অর্থঋণ আদালতে মামলা পরিচালনা করে আসা আইনজীবী জগবন্ধু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী, মামলা নিষ্পত্তি করার সর্বোচ্চ সময়সীমা হচ্ছে ১২০ দিন। কিন্তু কোনো মামলা এই সময়সীমার মধ্যে শেষ হয় না। আর চার মাস ধরে তিনটি আদালতে বিচারক না থাকায় মামলার জট আরও বেড়ে যাবে।

ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতের তথ্য বলছে, ঢাকার দ্বিতীয় অর্থঋণ আদালতে সর্বাধিক ১২ হাজার ১৪৭টি মামলা মামলা ঝুলে আছে। এরপর তৃতীয় অর্থঋণ আদালতে ঝুলে আছে ১১ হাজার ৭০টি মামলা। চতুর্থ অর্থঋণ আদালতে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৪৬৩টি মামলা। আর প্রথম অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে ৪ হাজার ১৮২টি মামলা। ৪টি আদালতে ৫ থেকে ১০ বছরের পুরোনো মামলার ১ হাজারেরও বেশি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীব উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে অর্থঋণ আদালত আইন হয়েছিল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হবে; সেটি কিন্তু পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না কিংবা ঋণের অর্থ দ্রুততম সময়ে আদায়ও হচ্ছে না। বিলম্বিত বিচার বাস্তবতার মধ্যে ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতের তিনটিতে চার মাস ধরে বিচারক পদায়ন না করায় আরও মামলা ঝুলে যাচ্ছে।