প্রযুক্তির উৎকর্ষের মধ্যেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে প্রায়ই বিকৃতভাবে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। গুগলে ‘ইনডিজেনাস পিপল’ লিখে খোঁজা হলে মাঝেমধ্যে এমন ছবি দেখানো হয়, যা তাদের ‘আদিম’, ‘বন্য’, ‘বর্বর’, ‘জংলি’ ও ‘হিংস্র’ আকারে উপস্থাপন করে।
সোমবার রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বক্তারা এমন অভিযোগ করেন। ‘আদিবাসী নারীর অধিকার রক্ষা ও ভবিষ্যৎ গড়ার লড়াইয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক।
আলোচনা সভায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ঘিরে এমন উপস্থাপনের প্রভাব নারীদের ওপরও পড়বে।
মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, দেশে জাতিসংঘের অনেকগুলো দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হলেও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হয় না। তিনি বলেন, বুঝুক আর না বুঝুক বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেনশনকে তড়িঘড়ি করে সমর্থন করে। কিন্তু এই কনভেনশনকে সমর্থন করেনি। সরকার বুঝেশুনেই সমর্থন করেনি। আগের সরকার বলেছে, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই, এই সরকারও আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
একটাই ধর্ম ও জাতিসত্তা থাকবে, এমন মনোভাব কাম্য নয় উল্লেখ করে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘কিসের ভয়ে আমরা দেশে ভিন্ন ধর্ম, চিন্তা ও জাতিসত্তার মানুষকে থাকতে দেব না? কে অধিকার দিয়েছে যে একটি মাত্র মতবাদ, চিন্তা, ভাষা জাতি ও ধর্ম থাকবে? রাষ্ট্রের জন্য এটা কাম্য হতে পারে না।’
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে সমতল ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করে খুশী কবির বলেন, অভ্যুত্থানের পরে আর নারীদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। নারী কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু কমিশনের কোনো কিছু গ্রহণ করা হয়নি। এর অর্থ সরকার নারীদের ভয় পায়। এই অবস্থা টিকে থাকার জন্য অভ্যুত্থান হয়নি। তাই অধিকার আদায়ে নারীদের শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। এখনই উত্তম সময়।
এআইয়ের তথ্য নির্ভুল রাখতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও নারী অধিকারকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আবু সাঈদ খান। তিনি বলেন, ‘এআইয়ের কাছ থেকে আমরা যেসব তথ্য পাব, সেটা ততক্ষণ পর্যন্ত ভুলে ভরা থাকবে, যতক্ষণ না আমরা সঠিক তথ্য সন্নিবেশিত করতে পারি। আদিবাসী ও নারী কর্মীদের এই তথ্য সন্নিবেশিত করার দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, পুরুষতন্ত্র দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অপর দিকে বিভিন্ন পন্থায় নারীকে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। সম্পদ ও বিভিন্ন সামাজিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সম্পদের ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।
আদিবাসী নারীরা সামগ্রিকভাবে সমাজের মূলধারায় নেই বলে উল্লেখ করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক বনশ্রী মিত্র। তিনি বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও অনেকে এগিয়ে আসেন না। একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যখন কোনো সহিংসতার শিকার হই, তখন সেটা বলতে লজ্জা পাই। কিন্তু মূলধারার মানুষের সেই লজ্জাও আমরা দেখি না। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সব শোষণ–বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে একসাথে এগিয়ে যেতে হবে।’
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা দুভাবে প্রান্তিক বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিচালক জনা গোস্বামী। তিনি বলেন, প্রথমত তাঁরা নারী, এরপর তাঁরা আদিবাসী। অনেক কিছু এখন গণমাধ্যমে আসছে না। অনেক কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পাওয়া যাচ্ছে। একেকটা ঘটনা এই জনগোষ্ঠীকে অনেক বেশি শঙ্কিত করছে। ম্রং সম্প্রদায়ের অনেকে এখনো ঘর থেকে বের হতে পারছে না।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে এগিয়ে নিতে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান সিভিক এনগেজমেন্ট ফান্ডের ডেপুটি টিম লিডার ক্যাথরিনা কুনিগ। তিনি বলেন, ‘এআই আমাদের সামগ্রিক কার্যক্রমের অনুষঙ্গ। কিন্তু যে নতুন প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করব, সেটা যেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে ঝুঁকিতে না ফেলে।’
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহসভাপতি লালসা চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ইয়ুথ অ্যান্ড সোশ্যাল কোহেসনের প্রধান ওয়াসিউর রহমান, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সহসাধারণ সম্পাদক হেলেনা তালাং। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
আলোচনা সভায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র জতিগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতা রোধে ব্যবস্থা, জড়িতদের শাস্তি, ভুক্তভোগীদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও আইনি সহায়তা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানোর বিশেষ উদ্যোগ, জাতীয় সংসদে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নারীদের প্রতিনিধিত্ব এবং নারী সদস্যদের জন্য কোটা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আলোচনা সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নারীদের গানের দল এফ মাইনর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দল আরফি, ত্রিপুরা, ওঁরাও, বম, খাসি, গারো সাংস্কৃতিক দল ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী শিল্পীরা।