‘আমার বাবা কি আর কখনোই ফিরবে না’

২০১৩ সালে সূত্রাপুর ও বংশাল এলাকার ৭ জন ছাত্রদল নেতা গুমের শিকার হন।

মা নিলুফার ইয়াসমিন ও ভাই আমিনুর রহমানের কাছ থেকে বাবার কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে ১০ বছরের শিশু সাদিকা সরকার। তার বাবা বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. সোহেল ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ঢাকা, ২৯ আগস্ট
ছবি : দীপু মালাকার

ছাত্রদল নেতা খালেদ হাসান যখন গুম হন, তখন তাঁর একমাত্র সন্তান সাদমান শিহাব ৫ বছর বয়সী ছিল। এখন তার বয়স ১৫ বছর। বাবার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই।

খালেদের বাসায় মঙ্গলবার বিকেলে কথা হয় তাঁর স্ত্রী শারমিন সুলতানার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাদমান যত বড় হচ্ছে, বাবা সম্পর্কে তার জিজ্ঞাসা ততই বাড়ছে। সে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করে, আমার বাবা কি আর কখনোই ফিরবে না? এই প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিতে পারি না। আমারও তো প্রশ্ন—আমার স্বামী কি ফিরবে না?’

খালেদ ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। ওই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা। তাঁকেও খালেদের সঙ্গে সেদিন তুলে নেওয়া হয়। একই দিন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজাও নিখোঁজ হন। তিনজনকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবার অভিযোগ করে আসছে।

ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজার বড় ভাই মো. ইসলাম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ বছর ধরে ভাই নিখোঁজ। আমরা জানতে চাই, আমার ভাইয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছে? সে বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে, সেটি অন্তত জানতে চাই। এক দশক ধরে ভাইয়ের খোঁজ জানি না, এটা যে কতটা যন্ত্রণার, সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।’

২০১৩ সালে সূত্রাপুর ও বংশাল এলাকার ৭ জন ছাত্রদল নেতা গুমের শিকার হন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন খালেদ, সম্রাট ও সেলিম। মঙ্গলবার বিকেলে সূত্রাপুরের জয় চন্দ্র ঘোষ লেনে খালেদের বাসায় যান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম ও দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন।

বিএনপির নেতারা মঙ্গলবার যখন খালেদের বাসায় যান, তখন সেখানে ছিল সম্রাট ও সেলিমের পরিবারও। মূলত গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস (বুধবার) উপলক্ষে বিএনপির নেতারা ওই বাসায় যান। সেখানে আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুকে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু গুমের চেয়ে কঠিন ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে আর নেই। আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৪ বছরের শাসনামলে দেশে গুম, খুনসহ যত অন্যায় হয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এসব বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা সরকারের বিরোধিতা করেন, তাঁদের গুম ও হত্যা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বংশালে চার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন বিএনপির নেতারা

সূত্রাপুরে গুমের শিকার তিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার পর বিএনপির নেতারা বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. সোহেলের বাসায় যান। সেখানে গুমের শিকার হওয়া আরও তিনটি পরিবার ছিল।

সোহেল ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। একই দিনে তাঁর সঙ্গে নিখোঁজ হন ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি মো. জহির, সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেন ও ছাত্রদলের নেতা মো. চঞ্চল।

চারজনের পরিবার বলে আসছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর তাঁদের গুম করা হয়েছে।

সোহেলের স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল যখন নিখোঁজ হন, তখন মেয়ে সাদিকা সরকারের বয়স ছিল মাত্র ২ মাস। এখন সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

নিলুফার বলেন, সাদিকার শুধু একটাই কথা, তার বাবা কোথায়? বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে চায় সে। এটা যে কতটা দুঃসহ যন্ত্রণার, সেটি কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।