মুক্তিযুদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার চিরন্তন প্রেরণা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।

তোফায়েল আউয়াল

দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালে যেসব বীর সন্তান পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন, জাতি চিরদিন তাঁদের কথা স্মরণ করবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা এখন সমাজ ও জীবনে কতটা প্রতিষ্ঠিত, তা নিয়ে ভাবতে গেলে নানা প্রশ্ন মাথায় আসে।

রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কতটা মর্যাদা দিয়েছে? শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাই তো এত দিনে প্রকাশ করা গেল না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাঠপর্যায়ে নানা গবেষক অনুসন্ধান করে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ঘটনা লিপিবদ্ধ করছেন। তা নিয়ে বই-পুস্তক প্রকাশিত হচ্ছে। সেগুলোকে প্রাথমিক তথ্যের উৎস হিসেবে নিয়েও তো আরও যাচাই-বাছাই করে সরকারি উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার একটি পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশ করা যেত। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫৩ বছর কেটে গেল। এখনো তা সম্ভব হয়নি।

বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ আর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রথাগত আলোচনা সভা বা সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেসব আলোচনায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শহীদ বুদ্ধিজীবী বা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা সেভাবে শোনা যায় না। এরপর সময়ের প্রবাহে বছর চলে যায়। এটা আমাদের মতো শহীদ পরিবারকে আশাহত করে, তাঁদের মনে বেদনা জাগায়।

এই প্রসঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চল নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী আমার বাবা আবদুল আউয়ালের আত্মদানের কথা স্মরণ করি। তিনি ছিলেন স্থানীয় এম কে সি এম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্কুলের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁদের দুর্গাপুর সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরও নানাভাবে সহায়তা করছিলেন। এ কারণে তিনি রাজাকার-আলবদরদের রোষানলে পড়েন। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট মধ্যরাতে বাবাকে তারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে তাঁকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরিশিরি ক্যাম্পের টর্চার সেলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। পরে সোমেশ্বরী নদীর পারে নিয়ে আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর দুর্গাপুরের মানুষ তাঁর স্মৃতির স্মরণে এম কে সি এম উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ‘আউয়াল স্মৃতি তোরণ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

আমার ধারণা, দেশে যে দলই এই পর্যন্ত ক্ষমতায় আসুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকৃত বাস্তবায়ন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের বা তাঁদের পরিবারকে যথাযথ সম্মান-স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতায় ঘাটতি ছিল না। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকারি উদ্যোগ এখনো পর্যাপ্ত নয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নিজেদের ও পরিবারের কথা না ভেবে জীবন উৎসর্গ করেছেন, স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরেও তাঁদের উত্তরসূরিদের কথা কেউ ভাবেনি। যেসব পরিবার সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন সেভাবে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে বর্তমান সরকারের শিথিলতাও আমাদের হতাশ করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের কাছে কোনো অনুগ্রহ চাই না। আমরা চাই, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হোক, রাষ্ট্র তাঁদের স্বীকৃতি দিক। দেশের নবীন প্রজন্ম যেন স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা বুদ্ধিজীবীদের নাম এবং সাহসী কীর্তির কথা জানতে পারে। দেশের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে চিরকালই সাহস, শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মকে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশ গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ করুক।

মো. তোফায়েল আউয়াল: শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল আউয়ালের সন্তান এবং ব্যাংক কর্মকর্তা