ঢাকায় বিষধর সাপের উপদ্রব আসলে কতটা বেড়েছে, কেন
রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে মানুষের বাসা, গ্যারেজ, বহুতল ভবনেও পদ্মগোখরা, রাসেলস ভাইপার, খৈয়াগোখরা ও রাজকেউটের মতো বিষধর সাপ পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে মানুষের উদ্বেগও বাড়ছে।
সাপ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক আদনান আজাদ। বেসরকারি এই সংগঠন এ বছর এ পর্যন্ত রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সাপ উদ্ধার করেছে ৩৫২টি।
আদনান আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে গত চার মাসেই বেশি সাপ উদ্ধার করেছেন তাঁরা। এসব সাপের বেশির ভাগই বিষধর।
গত ১ নভেম্বর রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি বাড়ির ফ্লোর ভেঙে ২টি পদ্মগোখরা, ৭টি বাচ্চা ও ১৮টি ডিম উদ্ধারের কথা জানান আদনান আজাদ। সাপের আতঙ্কে ভাড়াটেরা ওই বাসাই ছেড়ে যান।
আদনান আজাদ ফেসবুকে গত ৩০ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের কালিন্দীর আতাশুরের একটি কাগজের গোডাউন থেকে চারটি পদ্মগোখরার বাচ্চা উদ্ধারের ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেন।
এর আগে ২৮ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের একটি বাসা থেকে গোখরা সাপ উদ্ধারের তথ্য জানান আদনান আজাদ। ৭ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরার একটি আবাসিক এলাকার বাগান থেকে খৈয়াগোখরা উদ্ধার করা হয়। ১ অক্টোবর রাতে বনশ্রীর একটি বাসা থেকে বিশাল আকারের গোখরার মুখ হাতের মুঠোয় ধরে সে ছবিও পোস্ট করেন আদনান আজাদ।
আদনান আজাদ জানান, গত বছর তারা শতাধিক সাপ উদ্ধার করেছিলেন। এই বছর ১০ মাসেই সংখ্যাটি ৩৫২। শুধু রাজধানী থেকে ২০০টির বেশি উদ্ধার করেছেন।
এ বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বন অধিদপ্তরে ১১৩ বার সাপ উদ্ধারে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। গত বছরের পুরোটা সময় এ সংখ্যা ছিল ৮৮।
হুট করে রাজধানীসহ এর আশপাশ থেকে এত সাপ উদ্ধারের বিষয় অনেকে বিশ্বাস করছেন না। তাঁদের কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করে আদনান আজাদের পোস্টে মন্তব্যও করেছেন।
বন্য প্রাণী ও সাপবিশেষজ্ঞ মো. আবু সাইদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ও আশপাশে সাপ আছে। তবে বিষধর সাপ উদ্ধারের সংখ্যা অনেক বেশি মনে হচ্ছে। সাপ উদ্ধারকারী সংগঠন কোথা থেকে কত ধরনের সাপ উদ্ধার করল, এর বিস্তারিত তথ্য–উপাত্ত দিলে তা ধরে মাঠপর্যায়ে এ নিয়ে গবেষণা হওয়াটা জরুরি।
বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্য প্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক মনে করেন, মানুষ সচেতন হওয়ায় এখন সাপ উদ্ধারের ঘটনাগুলো জানা যাচ্ছে বেশি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে সাপ দেখলেই মানুষ মেরে ফেলত। এখন না মেরে বন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে সাপ উদ্ধারের জন্য।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২০ প্রজাতির সাপের তালিকা হয়েছে, যার মধ্যে ১৬ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ বিষধর প্রজাতি ৩৫টি।
এ বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত বন অধিদপ্তরে ১১৩ বার সাপ উদ্ধারে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। গত বছরের পুরোটা সময় এ সংখ্যা ছিল ৮৮। তবে বন অধিদপ্তরের সাপ উদ্ধারের জন্য আলাদা কোনো ইউনিট বা জনবল নেই। তাই তারা বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তা নেয়।
কয়েক বছর আগে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার বিভিন্ন জেলায় আতঙ্ক তৈরি করেছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলেছে, গত বছর মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জসহ ৩২টি জেলায় দেখা গেছে এ সাপ।
২০ বছর ধরে সাপ নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা আছে আবু সাইদের। এ জন্য জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ৪ হাজার ৪৭৭ প্রজাতির সাপের মধ্যে ২০ শতাংশ হলো বিষধর। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২০ প্রজাতির সাপের তালিকা প্রণীত হয়েছে, যার মধ্যে ১৬ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ বিষধর প্রজাতি ৩৫টি।
ঢাকায় সাপ বাড়ছে কেন
আদনান আজাদ বলেন, মানুষ জলাশয় ভরাট করে ফেলছে। এতে সাপের বাসস্থানের সংকট তৈরি হচ্ছে। সাপের গর্তে বৃষ্টির পানি ঢুকলে সাপ আশ্রয়ের জন্য শুকনা স্থান বা উঁচু স্থানে যাচ্ছে। ভবনের গেটের সঙ্গে বাগানবিলাসের মতো লতানো গাছগুলো বেয়েও সাপ বহুতল ভবনে ঢুকে যাচ্ছে। পাশাপাশি দুই বাড়ির মাঝখানের জায়গায় অনেকে খাবার ফেলেন। সেখানে ইঁদুরের আনাগোনা বাড়ে। ইঁদুর খাওয়ার জন্য সাপ সেখানে যায়, পরে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ে।
প্রতিবছর দেশে প্রায় চার লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। তার মধ্যে মৃত্যু হয় গড়ে ৭ হাজার ৫১১ জনের।
রাজধানীর বনশ্রী, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, বছিলা, উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর, খিলগাঁও, কচুক্ষেত, মিরপুর-২, নিকেতন, উত্তরার উত্তরখান ও দক্ষিণখানের মতো জায়গাগুলোয় বেশি সাপ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান আদনান আজাদ। এ এলাকাগুলোয় জলাশয় ভরাট করে আবাসিক ভবন তৈরি বাড়ছে।
বনশ্রীর কাউসার হোসেনের বাসা থেকে সাপ উদ্ধার করা হয়েছিল। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, সাপ দেখে তিনি কী করবেন, তা প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নম্বর পেয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
উত্তরা ১৮ নম্বরের একটি ভবনের ব্যবস্থাপক শফিউল্লাহ বিজয় জানান, এর আগেও সাপ দেখে তাঁরা নিজেরাই মেরে ফেলেছিলেন। পরে আবার সাপ দেখা গেলে উদ্ধারকারী সংগঠনের সহায়তায় সেই সাপ উদ্ধার করা হয়।
সাভারের বিরুলিয়ায় একটি এনজিওর কর্মী সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁর কার্যালয়ে সাপ দেখার পর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে খবর দেন তাঁরা।
সাপের কামড় এড়াতে কী করতে হবে
২০২৩ সালে দেশব্যাপী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনসিডিসি) চালানো এক জরিপ বলছে, প্রতিবছর দেশে প্রায় চার লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। তার মধ্যে মৃত্যু হয় গড়ে ৭ হাজার ৫১১ জনের।
সাপের কামড় গ্রামাঞ্চলেই বেশি ঘটে। গত বছর অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ মোট ১১টি প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ জরিপের বলছে, সাপের দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশ গ্রাম, বিশেষত চরের অধিবাসী। এসব ঘটনা ২৪ শতাংশই ঘটাচ্ছে বিষধর সাপ।
রাজধানী বা আশপাশে এখন পর্যন্ত কাউকে সাপে কামড় দিয়েছে—এমন তথ্য পায়নি অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। তবে আদনান আজাদ বলছেন, যেহেতু সাপ উদ্ধারের ঘটনা বেড়ে গেছে, তাই সাপের কামড়ের মতো দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। সে কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বড় হাসপাতালগুলোয় অ্যান্টিভেনম রাখতে হবে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহিন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বর্তমানে রাসেলস ভাইপারের ক্লিনিক্যাল প্যারামিটারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষধর সাপে কামড় দিলে কামড়ের জায়গায় তীব্র ব্যথা ও ফোলা ভাব হয়। জায়গাটি লালচে, নীলচে বা কালচে হয়ে যায়। রক্তপাত বা ফোসকা পড়ে। কোবরা ও ক্রেইটের বিষে চোখের পাতা ঝুলে পড়ে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় এবং গিলতে, কথা বলতে বা শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাসেলস ভাইপার সাপের বিষে মাড়ি, প্রস্রাব, বমি বা মল দিয়ে রক্ত আসে। রক্তচাপ কমে যাওয়া, কিডনির সমস্যা ও শরীর ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যা হয়।
সাপের কামড় এড়াতে শহুরে মানুষকেও রাতে চলাচলের সময় সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় সাপের গুরুত্ব তুলে ধরে আবু সাইদ বলেন, সাপ ক্ষতিকর পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ায়। ক্যানসার, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, ব্যথানাশক ওষুধসহ নানা অ্যান্টিভেনম তৈরি হয় সাপের বিষ থেকে। অথচ বিষ আছে এবং ছোবল মারতে পারে ভেবে মানুষ সাপ দেখামাত্র মেরে ফেলে। তাই সাপ চিনতে হবে, সাপ নিয়ে কুসংস্কার দূর করতে হবে। সাপে কামড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে।