অবিশ্বাস্য কয়েকটি দিন

দেশে ফিরে ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২
ছবি: সংগৃহীত

১৫ আগস্ট সকালে আব্বুর কাপাসিয়া যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু অভাবনীয়ভাবে ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। খুব ভোরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আমার সমবয়সী খালাতো বোন ইরিনা আগের রাতে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে থেকে গিয়েছিল। সে চিৎকার করে রিমিকে জড়িয়ে ধরল।

রাজশাহীর এসপি (আমাদের এক মামা ও আম্মার মামাতো ভাই) সৈয়দ আবু তালেব দুই দিন আগে সরকারি কাজে ঢাকায় আমাদের বাসায় উঠেছিলেন। তিনি হতভম্বের মতো ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর পাশে আব্বু ও কাজের ছেলে ইলিয়াস দাঁড়ানো। আমরাও একে একে বারান্দায় জড়ো হলাম। আম্মা চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘হঠাৎ এত গোলাগুলি কোথা থেকে আসছে।’

আব্বু বারান্দা থেকে দ্রুত ছাদে ছুটে গেলেন। রিমি ও আমিও গেলাম আব্বুর পেছনে পেছনে। দু-একটা গুলির শব্দ আবারও শোনা গেল। তারপর সব নিঃশব্দ হয়ে গেল। আব্বু নিচে নেমে বারান্দায় ইস্তিরির টেবিলের পাশে রাখা ফোনে বিভিন্নজনকে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন।

কিন্তু সেই ভোরে ফোনে কাউকেই পেলেন না। এরপর আব্বুর নির্দেশমতো রিমিও ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করল। মিন্টো রোডে অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সরকারি বাড়ির ফোন ধরল তাঁর মেয়ে বেবী। বেবী জানাল যে ওর বাবা নামাজ পড়তে গিয়েছেন এবং তাদের বাড়ির কাছেও অনেক গোলাগুলি হয়েছে। বেবি তখনো জানত না, মুজিব কাকুর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) ভগ্নিপতি খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসাতেও অভ্যুত্থানকারীরা আক্রমণ করে তাঁকেসহ তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করেছে।

আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত রিমির সহপাঠী ছিল। সে–ও নিহতদের মধ্যে ছিল। তাঁর বড় মেয়ে শেখ ফজলুল হক মনির স্ত্রী আরজু মনি তাঁর স্বামীসহ তাঁদের ধানমন্ডির বাসায় ১৫ আগস্ট ভোরে একই দলের গুলিতে নিহত হন। মুজিব কাকু ও তাঁর পরিবারের নিকটতম অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ একই দিনে, কাছাকাছি একই সময়ে অকালেই জীবন হারালেন। একটু সকাল হতেই আব্বু ফোনে খন্দকার মোশতাককে পেলেন। তিনি আব্বুর কাছে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

আব্বু রেডিও অন করলেন। ইথারে ভেসে এল মেজর ডালিমের উত্তেজিত কণ্ঠ, মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই বাক্যহারা হয়ে গেলাম। বেদনায় বিমূঢ় আব্বু গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মুজিব ভাই জেনে গেলেন না কে ছিল তাঁর প্রকৃত বন্ধু আর কে শত্রু। আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম, কারও সাধ্য ছিল না মুজিব ভাইয়ের শরীরে কেউ সামান্য আঁচড় কাটে।’ সপরিবার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, দশ বছরের বালক শেখ রাসেল, ছোট ভাই শেখ নাসের, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল (খুকী), পারভীন জামাল (রোজী)-সহ মুজিব কাকু নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় ব্রাসেলসে থাকায় তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান।

শিশু রাসেলকেও ছাড়েনি বর্বর ঘাতকের দল। ১৯৬৪ সালে যখন রাসেলের জন্ম হয়, আম্মার সঙ্গে আমি নবজাত শিশুকে দেখতে গিয়েছিলাম। মুজিব কাকির (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) কোল আলো করে রয়েছে ফুটফুটে রাসেল। আজ সে নেই! তাঁরা কেউ নেই! কী এক নির্মম ও অবিশ্বাস্য সত্যের মুখোমুখি আমরা সেদিন দাঁড়ানো!

রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাকের নাম ঘোষিত হওয়ার পর মনে হলো, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, মুজিব কাকুর অতি কাছের আস্থাভাজন এই ব্যক্তি নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সে এবং তার মতো ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই জানত যে আব্বু মুজিব কাকুর পাশে থাকলে তারা আঘাত হানতে পারবে না। সে কারণেই কুমন্ত্রণা ও ভুল পরামর্শ দিয়ে তারা মুজিব কাকুকে আব্বুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সকালবেলাটা ছিল উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা ও বেদনাসিক্ত। আশপাশের অনেকেই আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আব্বুর সাবেক একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীসহ অনেকে সকাল থেকেই আমাদের বাসায় ফোন করা শুরু করলেন। কেউ কেউ আব্বুকে বাসা ছেড়ে যাওয়ার উপদেশ দিলেন। আম্মা বারবার আব্বুকে অনুরোধ করলেন, ‘তুমি বাসায় থেকো না, আশপাশে কোথাও চলে যাও। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দেখো পরিস্থিতি কী হয়।’ আব্বু বাসা ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালেন না। আব্বুর মুখমণ্ডলজুড়ে কী নিদারুণ বেদনার ছাপ। আব্বুর এক সতীর্থ উপদেশ দিলেন ভারতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। আব্বু বললেন, ‘যে পথে একবার গিয়েছি, সে পথে আর যাব না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের বাসা ঘিরে ফেলল। সামনের বড় রাস্তাজুড়ে সেনাবাহিনীর অতিকায় ট্রাকগুলো মূর্তিমান আতঙ্কের মতো একে একে বাসার সামনে জড়ো হলো। আব্বুর সঙ্গে আমরা বাসার টেলিফোনের পাশে দাঁড়ানো। সেই মুহূর্তে একজন অফিসার দ্রুতগতিতে আমাদের দোতলার বারান্দায় উঠে এলেন। ক্যাপ্টেন শহীদ হিসেবে পরিচয়দানকারী এই অফিসার আম্মাকে বললেন, ‘এই মুহূর্ত থেকে আপনারা কেউ বাসার বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাইরের কেউ ভেতরে আসতে পারবে না।’ আব্বু প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘বলুন হাউস অ্যারেস্ট। আমাদের গৃহবন্দী করলেন।’

ক্যাপ্টেন শহীদ আমাদের কাছে একটা চাকু চাইলেন। তাঁর হাতে চাকু দেওয়ামাত্রই তিনি টেলিফোনের তারটি দ্বিখণ্ডিত করলেন। তারপর ফোনসেটসহকারে নিচে নেমে গেলেন। আমাদের নিচতলাটি একটি স্কুলকে ভাড়া দেওয়ার সময় আব্বু সামনের রুমটি ব্যক্তিগত অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য খালি রেখেছিলেন (ষাটের দশকেও ওই রুম তিনি অফিস, পড়ার ঘর ও বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার করতেন)।

সেই রুমকেই তারা তাদের থাকার জন্য বেছে নিল এবং বাসায় ছাদের ওপর অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফটগান স্থাপন করল। তাদের ব্যাপার স্যাপার দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল কোনো বাহিনীর মোকাবিলা করতে যাচ্ছে। ছোট সোহেল আমার কোলে চড়ে দোতলার জানালা দিয়ে নিচে রাস্তায় জমায়েত আর্মির ট্রাকগুলো দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ব’পা, মিলিটারি বন্দুক’!

এর পর থেকে আমরা সবাই বাসায়। সবার কাছ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। তারপর গভীর রাতে আমাদের দোতলার দরজার কলবেল আচমকা বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখা গেল যে হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর ডালিম ও তার সঙ্গে অন্য একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেজর ডালিম জানাল যে আব্বুর নিরাপত্তার জন্য বাসায় আর্মির পাহারা বসেছে। নিরাপত্তা ঠিক আছে কি না, সেটা দেখতেই তার আগমন। আব্বু তাকে ধমক দিয়ে বললেন যে তাদের আসার উদ্দেশ্য আসলে তিনি বন্দী হয়েছেন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া।

আব্বু বহু কষ্টে নিচের তলা থেকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৮ আগস্ট থেকে রিমি ও মিমির স্কুলে যাওয়ার অনুমতি জোগাড় করলেন। অন্তত বাইরের পরিস্থিতি রিমি স্বচক্ষে দেখে আমাদের জানাতে পারবে, যেটা আব্বু চিন্তা করেছিলেন। তাদের স্কুলে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঝামেলা পোহাতে হতো। তাদের ব্যাগ, বই, খাতাপত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করা হতো।

২২ আগস্ট শুক্রবার সকালে আমাদের বাড়ির সামনে পুলিশের দুটি জিপ এসে থামল। এক পুলিশ অফিসার এসে আব্বুকে বললেন, ‘স্যার, আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ আব্বুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা তিনি প্রকাশ করলেন না। আব্বু গোসল করে নাশতা খেয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন জামাকাপড় নিতে হবে কি না। অফিসার বললেন, ‘নিলে ভালো হয়।’

আব্বু একটা ছোট স্যুটকেসে কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিলেন। সঙ্গে নিলেন কোরআন শরিফ ও কালো মলাটের ওপর সোনালি বর্ডার দেওয়া একটা ডায়েরি, যাতে তিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালের কথা ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, তার নির্দেশনা। আব্বুর ঘরের সামনের বারান্দায় আমরা চার ভাইবোন দাঁড়িয়ে রয়েছি বিদায় দিতে। আব্বু আমাদের সবার মাথায় হাত বোলালেন।

আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী মনে হয়, কবে তোমাকে ছাড়বে?’ আব্বু সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই এক হাত নেড়ে বললেন, ‘টেক ইট ফরএভার, ধরে নাও চিরদিনের জন্যই যাচ্ছি।’ আমরা দৌড়ে লতাগুল্ম ও ফুলে ছাওয়া দোতলার জলছাদে এসে দাঁড়ালাম। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় আব্বু গাড়িবারান্দার ওপরের এই জলছাদে দাঁড়িয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ তাঁর ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে হাত নাড়তেন। আজ আমরা আব্বুকে বিদায় দিতে তাঁর উদ্দেশে হাত নাড়ছি।

আব্বু জিপে উঠতেই রাস্তার উল্টো দিকের মুদিদোকানের সামনে দাঁড়ানো নীল বর্ণের জিনসের ট্রাউজার পরিহিত এক বিদেশি আব্বুর জিপের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি আব্বুকে কী যেন বললেন, আব্বুও তাঁকে কী যেন উত্তর দিলেন। পুলিশ এবার তাঁকে বাধা দিল এবং আব্বুকে বহনকারী জিপটি শাঁ করে চোখের আড়াল হয়ে গেল।

আমাদের মনে প্রশ্ন ছিল, কে এই বিদেশি, তাঁর সঙ্গে আব্বুর কী কথা হয়েছিল? প্রায় ১১ বছর পর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন গ্রন্থের রচয়িতা মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে আমাদের ডেমোক্রেসি বুলেভার্ডের বাসায় বেড়াতে এসে জানালেন যে তিনিই ছিলেন সেই বিদেশি, যাঁর সঙ্গে আব্বুর কথা হয়েছিল। লিফশুলৎজ আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনাকে কি মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ আব্বু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার তা মনে হয় না।’ আব্বু যেন ধরেই নিয়েছিলেন, ওই যাওয়াই তাঁর শেষ যাওয়া। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)

সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ, ঐতিহ্য, ২০১৪

লেখক: শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা