ফুলবাড়ী দিবসে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে গণ–আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছে তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। ওই ঘটনার ১৯তম বার্ষিকীতে আজ মঙ্গলবার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিলেন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এবারের নির্বাচনে ‘প্রতিরোধ পর্ষদের’ প্রার্থীরা। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এ আয়োজনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, জাতীয় সম্পদ রক্ষায় ফুলবাড়ীতে যে চুক্তি হয়েছিল, সেটি কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গীকার ছিল। দুঃখজনকভাবে বিএনপি সরকারের সময় চুক্তি হলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
সাইফুল হক আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকেও আমরা ভেবেছিলাম, তারা রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে জনগণের স্বার্থে উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তারাও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; বরং দেখেছি, তারা বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, জনগণের স্বার্থকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেশের জ্বালানি সম্পদ নিয়ে সরকারের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ফুলবাড়ী আন্দোলনের ১৯ বছর পার হলো, কিন্তু ছয় দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও শহীদদের প্রতি অবমাননাকর। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, চুক্তি বাস্তবায়ন করা তাদের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। জনতার আন্দোলনের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। ফুলবাড়ী শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ফুলবাড়ীর ছয় দফা চুক্তি বিএনপির সঙ্গে হলেও আওয়ামী লীগ তাতে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল। তারা ক্ষমতায় এলে বাস্তবায়ন করবে বলে বারবার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা শুধু চুক্তি বাস্তবায়ন না করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং দমননীতি গ্রহণ করেছিল। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারণ করেছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে হতাশা জানিয়ে মোশরেফা মিশু বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, জনগণের স্বার্থে এ সরকার ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারাও কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি; বরং ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি দেশের স্বার্থবিরোধী, সেগুলো বহাল রেখেছে এবং নতুন নতুন চুক্তির পরিকল্পনা করছে। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা বিদেশি স্বার্থে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা উত্তোলনের জন্য এশিয়া এনার্জির সঙ্গে ৩০ বছরের একটি চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এর আওতায় উত্তোলিত কয়লার ৯৪ শতাংশ পেত এশিয়া এনার্জি। আর ৬ শতাংশ পেত বাংলাদেশ। বেশির ভাগই রপ্তানি হতো বিদেশে। এ চুক্তির ফলে পুরো ফুলবাড়ী ও আশপাশের এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
পরিবেশ ও জনজীবনে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় গঠিত হয় ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি। শুরু হয় আন্দোলন। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির কার্যালয় অভিমুখী স্থানীয় লোকজনের বিশাল জমায়েতে তৎকালীন বিডিআর গুলি চালালে তরিকুল, আমিন ও সালেকিন নামের তিনজন নিহত হন। এ সময় আহত হন দুই শতাধিক আন্দোলনকারী।
এরপর ফুলবাড়ীর পার্শ্ববর্তী পার্বতীপুর, বিরামপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ৩০ আগস্ট সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ করতে বাধ্য হয়। দাবির মধ্যে ছিল, এশিয়া এনার্জিকে বহিষ্কার করা এবং দেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন না করা।
সেই আন্দোলনের পর থেকে আজকের দিনটিকে ‘ফুলবাড়ী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন আন্দোলনকারীরা। এ দিন নানা আয়োজনে স্মরণ করা হয় ফুলবাড়ীর শহীদদের।