নানা রং-ছবির বই আর সিসিমপুরের আনন্দে মেতেছিল শিশুরা

বইমেলার শিশুপ্রহরে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখছে শিশু ঋষভছবি: প্রথম আলো

শিশুদের বইয়ের স্টলের সামনে অতি খুদে এক ‘পাঠক’ দুই হাতে একটা বই ধরে উল্টেপাল্টে দেখছিল। বাবা বইয়ের দাম মেটাচ্ছিলেন। কথা বলতে পারে কি না জানতে চাইলে শিশুর মা–বাবা বললেন, সুকুমার রায়ের ‘হনহন পনপন’ ছড়াটি মুখস্থ। পরিবারের কেউ একজন ছড়ার লাইনের প্রথম শব্দটি বললে সে দ্বিতীয় শব্দ বলে। যেমন কেউ একজন ‘কাজে’ বললে সে বলে, ‘ঠনঠন’...।

আজ শুক্রবার অমর একুশে বইমেলায় শিশুপ্রহরে ‘শিশু গ্রন্থ কুটির’ নামের একটি স্টলের সামনে দুই বছরের শিশু ঋষভ দাস রায়ের সঙ্গে দেখা হয়। শিশুটি নিজেই প্রচ্ছদ দেখে ‘ঈশপের গল্প’ বইটি পছন্দ করেছে। ঋষভের মা আনন দাস বললেন, অন্য শিশুদের মুঠোফোন আসক্তি দেখে তাঁরা ছেলের জন্মের পরপরই সচেতন ছিলেন বইয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়াতে। খাওয়ানোর সময় মুঠোফোনের পরিবর্তে ঋষভের হাতে বই দেন তাঁরা। নানি চেয়ার–টেবিল কিনে দিয়েছেন। ঋষভের নিজের একটি ‘লাইব্রেরিও’ আছে। সব বই সে নাড়াচাড়া করে। তাকে বই পড়ে শোনানো হয়। কোনো শিশুর হাতে মুঠোফোন দেখলে ঋষভ এখন রীতিমতো ‘শাসায়’।

রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা ঋষভের বাবা সৌমেন রায় বললেন, ছেলেকে নিয়ে বইমেলায় এসে তাঁর নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ছে। একসময় শিশু অবস্থায় মা–বাবার সঙ্গে তিনিও আসতেন। তখন বই পড়ার অফুরন্ত সময় ছিল। এখন কর্মজীবন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বই পড়ার সময়কে ছেঁটে ফেলেছে। সেই দুঃখবোধও ছেলেকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরিতে আগ্রহী করেছে।

সন্তানকে বইমুখী করতে সচেতন এমন আরও কয়েক পরিবারের সঙ্গে দেখা হলো বইমেলায়। বইমেলা শুরুর পর এর আগে দুটো শিশুপ্রহর গেলেও আজ ভিড় ওই দুদিনের তুলনায় বেশি বলে জানালেন বই বিক্রয়কর্মীরা। তাঁদের ভাষায়, মেলার শুরুতেই শুক্র ও শনিবার পেয়ে যাওয়ায় গতবারের তুলনায় বই ভালো বিক্রি হয়েছে। আর বইমেলার রীতি অনুসারে, দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিক্রি বাড়তে থাকে। শিশু গ্রন্থ কুটিরের ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান বলেন, তাঁদের স্টলে পাঁচ শর মতো শিশুতোষ বই রয়েছে। শিশুরা বিজ্ঞান, ধাঁধা, কৌতুকের বই পছন্দ করছে।

মেলায় আসা অভিভাবকদের কেউ কেউ বলেন, বইমেলা উপলক্ষে শুক্রবার মেট্রোরেল চালু থাকলে ভালো হতো। তাঁদের যাতায়াতে সুবিধা হতো।

চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি
আজ বইমেলায় শিশুপ্রহর বেলা ১১টা থেকে শুরু হলেও শিশুদের জন্য বাংলা একাডেমির ফটক খুলেছিল সকাল সাড়ে আটটায়। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ নিজ প্রাঙ্গণে ৮ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ফলে এলাকাটি সকাল থেকে শিশু ও অভিভাবকদের পদচারণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘ এলাকাজুড়ে লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে রং-তুলি দিয়ে ক্যানভাসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বঙ্গবন্ধুর ওপর ছবি আঁকছিল শিশু-কিশোরেরা।

সাওদা ইসলামের (৭) ক্যানভাসে ছিল শহীদ মিনার, ভাষা আন্দোলনের জন্য মিছিল আর সেই মিছিলের দিকে পুলিশের গুলিবর্ষণের দৃশ্য। গ্রিনরোডের বাসিন্দা রহিমা বেগম তাঁর মেয়ে জুরাইরা রহমানকে (১০) নিয়ে এসেছিল চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার জন্য। মিরপুরের পল্লবী থেকে আসা সামিয়া আলম (৯) আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বিখ্যাত কবিতা ‘কোন এক মাকে’ আবৃত্তি করবে বলে জানাল। শিশু বয়সে টাইফয়েডে পক্ষাঘাতগ্রস্ত কলেজছাত্রী খুকুমণি বড় বোনের সঙ্গে মেলা দেখতে এসেছিল হুইলচেয়ারে করে। লতা পাল ও নিরঞ্জন পাল দম্পতি নারায়ণগঞ্জ থেকে দুই ছেলে কুশল ও কুনালকে নিয়ে এসেছিলেন। লতা পাল জানান, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া প্রতিটি শিশুকে বই উপহার দিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। এবার বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি শিশুদের জন্য নতুন কোনো বই বের করেনি।

বাবার কোলে চড়ে সিসিমপুর দেখছে অটিস্টিক শিশু মুত্তাকির মাহাদি
ছবি: প্রথম আলো

হালুমের কথায় সবজি–মাছ খায় স্বরিৎ
বেলা ১১টা থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে শুরু হয় ভিড়। সকালে বাংলা একাডেমিতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শিশুরাও দলে দলে সেখানে আসতে থাকে। এক প্রান্তে সিসিমপুরের আয়োজন ঘিরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। বড়দের কারণে ছোটরা সামনে দেখতে বাধা পাচ্ছিল। কেউ বাবার ঘাড়ে, কেউ বাবা–মায়ের সহায়তায় টিনের বেড়ার সঙ্গে লাগানো বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে সিসিমপুরের চরিত্র ইকরি, টুকটুকির নাচ–গান, শিকুর হুক্কাহুয়া ডাক আর হালুমের ছড়ায় ছড়ায় উপদেশ উপভোগ করছিল।

রাজধানীর এজি চার্চ স্কুলের কেজি শ্রেণিতে পড়া তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্বরিৎ ঋতি ভোর, আলিজা ইউসুফজাই আর নুসাইরা মাহমুদের মা–বাবা সন্তানদের নিয়ে দল বেঁধে এসেছিলেন। এর মধ্যে স্বরিৎ ঋতির মা নাহিদা খানম বলেন, তাঁর মেয়ে সিসিমপুরের ভক্ত। প্রতিবারই তাঁরা মেলায় মেয়েকে নিয়ে আসেন। সিসিমপুরের হালুমের কথায় মাছ আর সবজি খাওয়া শিখেছে তাঁর মেয়ে। স্বরিৎ বলল, ‘হালুম বলে, মাছ খেতে ভারি মজা।’ তাই সে মাছ খায়। হালুম ঢ্যাঁড়স, ফুলকপি, গাজর, টমেটো খেতে বলে।

দুই বছর বয়সী তাফান্নুম ইসলাম বাবার ঘাড়ে চড়ে সিসিমপুর দেখছিল। আট বছরের অটিস্টিক শিশু মুত্তাকির মাহাদির মুখে হাসি লেগেই ছিল। সে এসেছিল বাবার কোলে চড়ে। বাবা মো. শওকত আলী বললেন, ছেলে সিসিমপুর বোঝে না। তিনি ছেলেকে একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন।

একেকজনের একেক বই পছন্দ
তাসমিয়াতুন জান্নাত (৮) বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ‘অনুপম প্রকাশনী’ থেকে তার পছন্দমতো বিজ্ঞানের বই ‘গল্পে জল্পে জীববিজ্ঞান’ কিনেছে। তাসমিয়াতুন জানাল, বই পড়তে তার খুব ভালো লাগে। ‘আরো প্রকাশন’ থেকে আনাস হাসানাতকে (৭) বাবা শাজাহান সাজিদ কিনে দিলেন ‘আবিষ্কার আর আবিষ্কার’ নামের বইটি। অনুপম প্রকাশনীর সহকারী ব্যবস্থাপক বললেন, মেলা উপলক্ষে তাঁরা শিশুদের জন্য ২০টির মতো নতুন বই প্রকাশ করেছেন।

‘প্রথমা’ প্রকাশনের সামনে কথা হয় চট্টগ্রাম সরকারি মডেল কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুব্রত কুমার ভৌমিকের সঙ্গে। তিনি স্ত্রী, আট বছর বয়সী মেয়ে ও পাঁচ বছর বয়সী যমজ সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন। তিনি জানালেন, গতকাল রাতে ট্রেনে চট্টগ্রামের খুলশী থেকে এসেছেন বইমেলার জন্য। আগামীকাল ফিরে যাবেন। প্রথমা থেকে বড় মেয়ে পার্বতী ভৌমিক ‘গণিতের ধাঁধা’, ‘গণিতের খেলা গণিতের কাজ’, ‘অদৃশ্য পৃথিবী’ কিনেছে। কারণ, তার গণিত ও বিজ্ঞান বেশি পছন্দ।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাজানো ‘পাঞ্চজন্য’ শঙ্খের নামে নাম পাঞ্চজন্য দেবনাথের (১২)। সাভার থেকে বাবার সঙ্গে আসা এই কিশোর ‘প্রথমা’য় খুঁজছিল ‘ভূতের বই’। ‘প্রথমা’ এবারের মেলায় এখন পর্যন্ত শিশু ও কিশোরদের ১৭টি নতুন বই প্রকাশ করেছে।

শিক্ষক সুব্রত ভৌমিকের ভাষ্য, শিশুদের গুরুত্ব দিয়ে আরও বেশি বই প্রকাশ করা উচিত। সেসব বইয়ের কাগজ যেন মানসম্মত হয় আর বইয়ের পাতায় রং ও ছবির ব্যবহার বেশি থাকে।