১৯৬০ সালের সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহে কেমন ছিল ঢাকার জীবনযাত্রা

স্বাধীনতার আগে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল। ওই দিন তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখা গিয়েছিল ৫৪ বছর পরে, ২০১৪ সালের ১৪ ও ২৩ এপ্রিল, ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় একই তাপমাত্রা আবার রেকর্ড করা হয় ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল।

ঢাকার তাপমাত্রা আগের সেই রেকর্ড এখনো স্পর্শ করেনি, তবে জীবনযাত্রা তাতেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। যতটা তাপমাত্রা, তার চেয়ে অনুভূত হচ্ছে বেশি। অনুভূত হওয়াকেই বেশি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়, যাবে বলে ‘হিট ইনডেক্স’ বা তাপ সূচক। তাপ সূচক হলো বায়ুর তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা বা জলীয় বাষ্পের মিশ্রণ বিবেচনা করে একজন মানুষের দেহে আবহাওয়া কতটা গরম অনুভব করাবে, তারই পরিমাপ। সুতরাং বাতাসের আর্দ্রতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

১৯৭২ সালের ১৮ মে

ঢাকার তুলনায় দেশের কিছু স্থান আছে, যেখানে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হয়। যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকা এর আওতায় পড়ে। তবে ঐতিহাসিকভাবে পুরো বাংলাদেশ ধরলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখা দিয়েছিল রাজশাহীতে, ১৯৭২ সালের ১৮ মে। ওই দিন তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হলেও সে সময় কিন্তু গরম নিয়ে এত হইচই ছিল না। তাহলে কি তাপ সূচক বা হিট ইনডেক্স কম ছিল? অথবা হতে পারে তখন সদ্য স্বাধীন দেশ নানা ধরনের সংকটে নিমজ্জিত ছিল। সাধারণ মানুষের জন্য তখন সূর্যের আগুনের চেয়েও বড় সংকট ছিল বাজারের আগুন। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। অর্থনীতির অবস্থা তখন ভালো ছিল না। সরবরাহ কম ছিল, মজুতদারিও ছিল ব্যাপকভাবে। ফলে মানুষের মূল উদ্বেগের জায়গা ছিল বাজার।

এ কারণেই ১৯৭২ সালের ১৯ মে বাংলার বাণীর মূল শিরোনাম ছিল ‘দ্রব্যমূল্যের উর্দ্বগতি রোধের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে’। এটি ছিল আগের মন্ত্রিসভার বৈঠকের আলোচনা ধরে। পত্রিকাটিতে আবহাওয়া নিয়ে কোনো সংবাদ ছিল না। এক দিন পরে ছিল ডাকসুর নির্বাচন। এ নিয়েই সংবাদ ছিল বেশি। তবে ভেতরের পাতায় একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘বাজারে জিনিসপত্র না থাকলে অগ্নিমূল্য দিলে তা আসে কোথা থেকে?’ ইঙ্গিত মজুতদারির দিকে।
দৈনিক ইত্তেফাকেও ওই দিন আবহাওয়া বা তাপমাত্রা নিয়ে কোনো সংবাদই ছিল না। সেখানে ছিল দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ। আরেক জাতীয় দৈনিক সংবাদেও আবহাওয়া নিয়ে কোনো খবর ছিল না। তবে মেহেরপুরে যে চালের মণ ১০০ টাকা উঠেছে, সেই খবর ছিল। অর্থাৎ সেই বাজারের আগুন।

দৈনিক বাংলা, ১৯ এপ্রিল, ১৯৭২

একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা। প্রথম পাতায় এক কলামে একটি সংবাদ ছিল। শিরোনাম ছিল, ‘রাজশাহীতে ১১৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা: ঢাকায় আজ ঝড় হতে পারে’। সংবাদটিতে বলা ছিল, ‘আজ ঢাকা শহরে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। সে সঙ্গে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল বেগে কালবোশেখীও। চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্যও আজ শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাসও এই বলে আবহাওয়া দফতর জানিয়েছেন।

‘গতকাল দেশের সবচেয়ে বেশী গরম পড়েছে রাজশাহীতে-১১৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট। ঢাকায় দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট ও ৮৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট। গতকাল ফরিদপুরে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে।’
বলে রাখা ভালো, তখন তাপমাত্রা প্রকাশ করা হতো ফারেনহাইটে। এখন বলা হয় সেলসিয়াস।

৩০ এপ্রিল, ১৯৬০

আগেই বলা হয়েছে, স্বাধীনতার আগে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিলে। পত্রিকার পাতা খুললেও জানা যায় যে সেই দিনটি কতটা অসহনীয় ছিল, জনজীবন কতটা বিপর্যস্ত হয়েছিল। সে সময় দেশের অন্যতম জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক ছিল আজাদ। পরদিন, ১ মে প্রথম পাতায় যে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, তাতে সে সময়ে ঢাকার একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। আজকের দিনের পাঠক একটা সুখপাঠ্য লেখার অভিজ্ঞতাও তাতে পাবেন। বানানরীতি একই রকম রেখে লেখাটি পড়া যাক—

রুদ্র বৈশাখ!

বৈশাখ মাসের অর্ধেকের বেশী চলিয়া গিয়াছে। এখনও আকাশে মেঘের নামগন্ধ নাই। গরমের প্রচণ্ডতাও ক্রমশ: বাড়িয়া চলিয়াছে। এই সময়ে রাতদিন একটানা যে দক্ষিণা বাতাস বহে তাহাও কয়েকদিন বন্ধ। দিনের প্রচণ্ড গ্রীষ্মের পর সন্ধ্যার হাওয়া কয়েকদিন আগে যে শীতলতা আনিয়া দিতেছিল তাহাও আর নাই। বরঞ্চ দিনের বেলায় হাওয়া যেটুকু বহে তাহা আগুনের ছোঁয়াচ আনিয়া রুদ্র বৈশাখ নামটিকে সার্থক করিয়া তুলিতেছে। পিচ ও কংক্রিটের তপ্ত রাস্তা পথিকের বিভীষিকা উৎপাদন করিতেছে।

‘নিধন’ অভিযানের হাত কাটাইয়া যে কয়টি সারমেয় এখনও বাঁচিয়া রহিয়াছে, সেগুলি খাদ্যের অন্বেষণে পথিপার্শ্বস্থ ডাস্টবিনের কাছে পর্যন্ত ঘেষিতেছে না। বরঞ্চ নর্দমা বা নীচ স্থানে যেখানে একটু পানি পাইতেছে, সেখানে খানিকক্ষণ বসিয়া গা ঠান্ডা করিতেছে। খানা, ডোবা ও পুকুরগুলি স্নিগ্ধতাকামী নরনারী ও শিশুরা মুখরিত করিয়া রাখিতেছে। সামান্য চিনি মিশ্রিত বরফ পানি অভিজাত সরবত হইয়া পথচারীর তৃষ্ণা নিবারণ করিতেছে। দুপুরে গৃহস্থ বাড়ীর দ্বারে ‘চাই লেস ফিতা শাড়ী ব্লাউজ’ হাঁক আর বড় একটা শোনা যায় না। দুপুরের প্রখর রৌদ্রে বাসের প্রতীক্ষায় সারি দিয়া দণ্ডায়মান অফিস ফেরত শ্রান্তক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত্ত কর্মচারীদের সম্মুখ দিয়া প্রতীক্ষিত বাস কাহাকেও না লইয়া অথবা সম্মুখের মাত্র ২ জনকে লইয়া চলিয়া গিয়া তাহাদের নিরাশা ও ক্লান্তি আরও বাড়াইয়া তুলিতেছে।

১ মে, ১৯৬০, দৈনিক আজাদ

গ্রীষ্মের দরুন সমুদয় অফিস আদালতের কাজ এখন সকাল ৭টায় শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মাবকাশ শুরু হইয়াছে। কলেজেও মর্নিং ক্লাস হইতেছে। যেসব স্কুল দশটায় চলিতেছে, সেগুলিতে ছাত্রদের দুর্দশার কথা ভাবিয়া অভিভাবকগণ তাহাদের স্কুল গমন বন্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছেন।

বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রা: আবহাওয়া অফিসের খবরে প্রকাশ, একমাত্র কক্সবাজার ছাড়া সমগ্র পূর্ব্ব পাকিস্তানেই তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রীর উপরে উঠিয়াছিল। গতকল্য ঢাকা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, জামালপুর ও শ্রীমঙ্গলে তাপমাত্রা ১০৮ ডিগ্রী হয়। এছাড়া বরিশালে ১০৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০৬, চট্টগ্রামে ১০৫, কুমিল্লায় ১০১, দিনাজপুরে ১০১, ফরিদপুরে ১০৭, যশোরে ১০৭, খুলনায় ১০৭, মাইজদী কোর্টে ১০৫, মোমেনশাহীতে ১০৭, নারায়ণগঞ্জে ১০৭, পাবনায় ১০৭, রংপুরে ১০৫, সিরাজগঞ্জে ১০৭ ও সিলেটে ১০৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা উঠে।

পতেঙ্গা হইতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে প্রকাশ, অদ্যও প্রদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকিবে এবং তাপমাত্রা আধ ডিগ্রি বেশি কম হইতে পারে।

১ মে, ১৯৬০, সংবাদ
সৌজন্যে–সংগ্রামের নোটবুক

একই দিনে দৈনিক সংবাদের মূল বিষয়বস্তু ছিল ‘প্রচণ্ড খরতাপ ও অনাবৃষ্টিতে আউশ ও রবিশস্যের সমূহ ক্ষতি। ঢাকা ও কতিপয় স্থানে ১০৮.১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত: শুষ্ক আবহাওয়া অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা। দুপুরে রাস্তাঘাট জনশূন্য।’