রফিকুলের লাঠির জাদুঘর

ফণাতোলা সাপের মতো দেখতে রফিকুল ইসলামের তৈরি করা লাঠি
ছবি: প্রথম আলো

নানা ঘেতু মোল্লা সুন্দর সুন্দর লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াতেন। নানার হাতের বাহারি লাঠি দেখেই এর প্রেমে পড়ে যান রফিকুল ইসলাম। পরে সেই ‘প্রেম’কে শখ বানান তিনি। ১৪ বছর ধরে বিচিত্র ধরনের লাঠি তৈরি করে চলেছেন রাজশাহীর কাটাখালী পৌর এলাকার দেওয়ানপাড়া মহল্লার এই বাসিন্দা।

গত ১৭ ডিসেম্বর তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ‘এল প্যাটার্নের’ বাড়ির বারান্দাটা যেন লাঠির জাদুঘর। কোনোটি ফণাতোলা সাপের মতো দেখতে। কোনো লাঠির মুখ কেটে তিনি কুমিরের মুখের আকার তৈরি করেছেন। একটি লাঠি দেখলে মনে হবে, কোনো বাউলের মুখ। একটি লাঠির মাথায় পতাকা বাঁধা। কেউ যেন নিচে বসে লাঠিটা সোজা করে ধরে রেখেছে। কাছে গিয়ে দেখলে মনে হবে, দুটি অচেনা প্রাণী পাশাপাশি বসে লাঠিটা ধরে আছে। কোনোটি কুমির। কোনোটি শিয়াল। কোনোটিতে পাখির ঠোঁট, মানুষের চোখ। সব লাঠির মাথায় এসব অদ্ভুত কারুকাজ।

১৪ বছরে রফিকুল ১৭০টি লাঠি তৈরি করেছেন
ছবি: প্রথম আলো

রফিকুল ইসলাম বাঁশ দিয়ে এ রকম বিচিত্র লাঠি তৈরি করেন। ৫৫ বছর বয়সী মানুষটি পেশায় মোজাইকমিস্ত্রি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেটে নেওয়ার পর বাঁশের যে অংশ মাটির নিচে ও ওপরে অবশিষ্ট থাকে, রফিকুল সেই অংশ লাঠি তৈরি করার জন্য মাটি খুঁড়ে তুলে আনেন। মাটির ভেতরে বাঁকা হয়ে বাঁশের গোড়া যেদিকে গেছে, তিনি অবিকল সেইভাবে তুলে আনেন। একটি বাঁশের গোড়া মাটি খুঁড়ে তুলতে তিন দিন পর্যন্ত সময় নিয়েছেন তিনি। আবার দেখা যায়, যেসব বাঁশ কোনো কাজে লাগবে না বলে ঝাড়ের মালিক কেটে নেন না, রফিকুল সেই বাঁশটিকে নিয়ে এসে একটি শৈল্পিক রূপ দিয়ে লাঠি তৈরি করেন। শিকড়সুদ্ধ বাঁশের গোড়া তাঁর হাতের জাদুতে হয়ে ওঠে কোনো প্রাণীর মুখ।

নিজের হাতে গড়া অচেনা প্রাণীগুলোর পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে রফিকুল বলেন, ‘আমার তো তেমন পড়াশোনা নাই, জীববিজ্ঞানীরা হয়তো বলতে পারবেন।’

রফিকুল দিনের বেলায় মিস্ত্রির কাজ করেন। আর রাত জেগে বানান লাঠি। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। টানাটানির সংসার। বড় ছেলেও স্যানিটারিমিস্ত্রির কাজ করেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে এবার এসএসসি পাস করেছে। স্ত্রী সাবিনা বেগম স্বামীর লাঠি তৈরির কাজকে বেগার খাটা মনে করেন। বললেন, ‘প্রথম প্রথম চিল্লাচিল্লি করেছি। কিন্তু বলে কোনো কাজ হয় না। সংসার নিয়ে তঁার কোনো ভাবনা নেই। ১০ টাকা ধার করতে হলে আমাকে করতে হয়। সপ্তাহান্তে কাজ করে বাড়ি এসে সারা রাত ওই লাঠি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এখন কিছু করার নেই। ও যেহেতু লাঠিকেই ভালোবাসে, এখন আমরা সবাই লাঠিরই যত্ন করি। নিয়মিত তেল মালিশ করি।’

রফিকুল দিনের বেলায় মিস্ত্রির কাজ করেন। আর রাত জেগে বানান লাঠি
ছবি: প্রথম আলো

গত ১৪ বছরে রফিকুল ১৭০টি লাঠি তৈরি করেছেন। রফিকুল মনে করেন, এই লাঠির প্রদর্শনী করলে মানুষের ঢল নামবে। কিন্তু এই লাঠি তিনি বিক্রি করবেন না। বিকেলে কখনো কখনো লাঠি হাতে তিনি পাড়ার মোড়ে বের হন, তখন চারদিক থেকে মানুষ লাঠি দেখার জন্য তাঁকে ঘিরে ধরে। কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু রফিকুল যাকে যা বলে বোঝানো যায়, বুঝিয়ে চলে আসেন। বিক্রি করেন না।

সম্প্রতি দেওয়ানপাড়ায় বাড়ি করার জন্য জমি কিনেছেন সুলতান মাহমুদ নামের পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মচারী। তিনি বললেন, হঠাৎ এক বিকেলে বিচিত্র এক লাঠি হাতে রফিকুল ইসলামকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখেন। লাঠিটা তাঁর খুবই পছন্দ হয়। তিনি সেটা কেনার জন্য বায়না ধরেন। কিন্তু কিছুতেই রফিকুল লাঠিটি বিক্রি করতে রাজি হননি। পরে তিনি জানতে পারেন, এটি রফিকুল ইসলামের শখ। তিনি লাঠি বিক্রি করেন না। এ কথা শুনে তিনি যারপরনাই অবাক হয়েছেন।

রফিকুল ইসলামের আশা, মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে তাঁর মতো করেই লাঠিগুলো আগলে রাখবে।