গণ-অভ্যুত্থান ছিল সাগরের মতো বিশাল

জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে ‘জুলাই-জাগরণ’ শিরোনামে প্রথম আলোর আয়োজনে বিশেষ প্রদর্শনীর তৃতীয় দিনে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথিরা। (বাঁ থেকে) আল মাসুদ হাসানউজ্জামান, আলী রীয়াজ, আসিফ নজরুল ও সাজ্জাদ শরিফ। গতকাল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

রাজপথে বয়ে গেছে রক্তের স্রোত। রাজধানী থেকে মফস্‌সল সর্বত্র হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে ফুঁসে উঠেছিল মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা। বিপুল এই গণ-আন্দোলনের স্মৃতিকে ধারণ করে প্রথম আলোর আয়োজনে চলছে ‘জুলাই-জাগরণ’ নামে বিশেষ প্রদর্শনী। সেই প্রদর্শনী ঘুরে দেখে অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ অংশ নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের অভিমত, এই অভ্যুত্থান ছিল এক বিশাল সাগর। প্রদর্শনী দেখে তা উপলব্ধি করা যায়।

গত শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় শুরু হয়েছে আট দিনের এ প্রদর্শনী। দেশের ইতিহাসের মোড় ঘোরানো এই অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে প্রথম আলোর সাংবাদিকতা ও অভ্যুত্থানের নানা প্রামাণ্য উপকরণ তুলে আনা হয়েছে এ প্রদর্শনীতে। এতে আছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনের আলোকচিত্র, ভিডিও, প্রথম আলো পত্রিকার বড় আকারে ডিজিটাল প্রিন্ট, শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে শিল্পকর্ম ও শিল্প সৃষ্টির ভিডিও, আন্দোলন দমনে পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর ব্যবহৃত গুলির খোসা, গ্রেনেডের পিন, শহীদদের ব্যবহৃত স্মৃতিময় সামগ্রীসহ অনেক উপকরণ। প্রদর্শনী উপলক্ষে রয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান।

অভ্যুত্থানের চার বই

প্রদর্শনীতে গতকাল রোববার ছিল গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত চারটি বইয়ের আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা। বিকেলে এ অনুষ্ঠানে বইগুলোর লেখক ও সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।

বইগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের লেখা শেখ হাসিনার পতনকাল। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজের আমিই রাষ্ট্র: বাংলাদেশে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানউজ্জামানের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান: নতুন পথে বাংলাদেশ। বইটি আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম মুদ্রণ দ্রুতই শেষ হয়েছে। এখন এসেছে দ্বিতীয় সংস্করণ। আরেকটি প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষ্য।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রদর্শনী প্রসঙ্গে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান ছিল সাগরের মতো বিশাল একটি বিষয়। আমি তার ক্ষুদ্র একটি অংশে ছিলাম। এই প্রদর্শনী থেকে অভ্যুত্থানের সেই বিশালতা উপলব্ধি করা যায়।’ বইটি সম্পর্কে তিনি বলেন, গত চার বছর প্রথম আলোতে যেসব কলাম লিখেছেন, সেখান থেকে বাছাই করে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার যে বিপুলভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, যে লুটপাট হয়েছে, সেই সময়ের চিত্র এসেছে এই বইয়ে। পত্রিকায় তখন অনেক কিছুই সরাসরি লেখা যেত না। অনেক চাপ ছিল। বই করার সময় বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে।

আসিফ নজরুল আন্দোলনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘তখন প্রতিটি মুহূর্তে গ্রেপ্তার ও মৃত্যুর ভয় ছিল। আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। ছাত্রদের সমন্বয়কদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তাঁরা অসমসাহসিকতায় প্রমাণ করেছেন তাঁরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। এ অভ্যুত্থানে দেশের মানুষ আবার প্রমাণ করেছেন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ করতে ভয় পান না।’ তিনি বলেন, বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। অভ্যুত্থানের সময় যে বিপুল ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দেশ দুবার প্রবল ব্যক্তি স্বৈরতন্ত্রকবলিত হয়েছিল।

প্রথমবার হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্রকে হত্যার মাধ্যমে। তখন এক দেশ, এক নেতা, এক পার্টি স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। দ্বিতীয়বার আবার এক ভয়ানক স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেন শেখ হাসিনা।

আলী রীয়াজ বলেন, কেন বারবার ব্যক্তিগত স্বৈরতন্ত্রের সৃষ্টি হচ্ছে, এ বইয়ে এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন তিনি। পাশাপাশি কী করে এ থেকে উত্তরণ লাভ করা যায়, সেই দিকও উল্লেখ করেছেন।

অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানউজ্জামান বলেন, যে বিপুল অভ্যুত্থান হলো, এর গণ–আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনা তিনি তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এই গণ-আন্দোলন নিয়ে আরও অনেক বড় মাপের গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তিনি প্রাথমিক কাজটি শুরু করেছেন।

সাজ্জাদ শরিফ বলেন, প্রথম আলো অভ্যুত্থান নিয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রোড়পত্র প্রকাশ থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, গ্রাফিতি, কবিতা, সাক্ষাৎকার, নাগরিক মতামত—এসব নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য লেখা সংকলন করে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে।

মতিউর রহমান বলেন, গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে ভবিষ্যতেও নানা পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম আলো এবং প্রথমা প্রকাশন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাজ করেছে। এখন জুলাই অভ্যুত্থান নিয়েও বহুমাত্রিক কাজ করবে। এরই ধারাবাহিকতায় এ প্রদর্শনী আয়োজন ও চারটি বই প্রকাশিত হলো।

জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনী চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত, প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা অবধি।

আজকের অনুষ্ঠান: আজ সোমবার প্রদর্শনীতে শহীদ পরিবারের সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে।

অতিথি থাকবেন সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন।