সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
কমিউনিটি ক্লিনিক হবে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র
দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ১৩ হাজার ৯২৬টি।
এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক ছয়-সাত লাখ মানুষ সেবা নেন।
কমিউনিটি ক্লিনিকের নাম পাল্টে দিয়ে ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র’ করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের পদবি ও কাজের ক্ষেত্রও পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবারও একটি সংজ্ঞা ও সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন বলেছে, সংবিধানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। দেশের সব নাগরিককে বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আইনগতভাবে সরকার বাধ্য থাকবে। এ জন্য নতুন আইন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
৫ মে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সংজ্ঞা কী হবে, এই সেবার আওতা কোন পর্যন্ত হবে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সংজ্ঞা দিয়েছে কমিশন।
মোটা দাগে পাঁচ ধরনের সেবা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় থাকবে। এক. যোগাযোগ সেবা: মানুষকে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে তথ্য প্রদান; দুই. স্বাস্থ্য উন্নয়ন: শিশু ও মাতৃমঙ্গল সেবা, কৈশোরকালীন সেবা, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; তিন. সীমিত পর্যায়ে রোগের চিকিৎসা: নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, গোদ রোগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, আমাশয়, চোখ ওঠা, কানের প্রদাহ, ত্বকের খোসপাঁচড়া ও অন্য রোগ, দাঁতের মাড়ির প্রদাহ, নাকের প্রদাহ, সাধারণ জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, পাকস্থলীতে অ্যাসিডের আধিক্য, কুকুর ও সাপের কামড়, পানিতে ডোবা, গলায় কিছু আটকে যাওয়া, দুর্ঘটনাজনিত সাধারণ জখম ও রক্তপাত, হাড় ভাঙার চিকিৎসা, কৃমিনাশ, রক্তস্বল্পতা, জটিলতাবিহীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, অস্থিসন্ধির ক্ষয় ও ব্যথা, মানসিক সমস্যা, জননেন্দ্রিয়ের ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ; চার. পরিবার পরিকল্পনা সেবা; এবং পাঁচ. রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণসেবা: ইপিআই, রোগ পরিবীক্ষণ বা নজরদারি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ১৩ হাজার ৯২৬টি। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক ছয়-সাত লাখ মানুষ সেবা নেন।
নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ-এর আহ্বায়ক ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফউদ্দীন বেননূর এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়াকে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনার সুপারিশটি জনমুখী। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের আওতা স্পষ্ট করেছে সংস্কার কমিশন। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগের মতো বিষয়কে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় রাখা ঠিক হবে না। এই রোগ শনাক্তকরণে ও চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। এটা প্রাথমিক স্তরে করা সম্ভব নয়।
নতুন নামকরণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে নামকরণ করতে হবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রগুলোর নাম ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম প্রাথমিক রেফারেল স্বাস্থ্যকেন্দ্র করার প্রস্তাব করেছে কমিশন।
১৯৯৮ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলার কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কমিউনিটি ক্লিনিক আবার চালু করার চেষ্টা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সর্বনিম্ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য অবকাঠামো হিসেবে সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ১৩ হাজার ৯২৬টি। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক ছয়-সাত লাখ মানুষ সেবা নেন। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), তিন দিন কাজ করেন স্বাস্থ্য সহকারী এবং বাকি তিন দিন কাজ করেন পরিবার কল্যাণ সহকারী। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এখন পরিচালিত হয় কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায়।
দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগের মতো বিষয়কে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় রাখা ঠিক হবে না। এই রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। এটা প্রাথমিক স্তরে করা সম্ভব নয়।কাজী সাইফউদ্দীন বেননূর, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
শুধু নাম নয়, কমিউনিটি ক্লিনিকের সঙ্গে জড়িত তিন স্বাস্থ্যকর্মীর পদবি পরিবর্তনেরও সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সিএইচসিপি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী—এই তিন পদের নাম হবে একটাই, গ্রামীণ স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মী।
স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের ক্ষেত্রও কিছু পরিবর্তন হবে। ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসক সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত সভায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে) অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়টি সংবেদনশীল। কমিউনিটি ক্লিনিক এলাকায় সেবার দ্বৈততা আছে। একটি পরিবারে স্বাস্থ্যের কর্মী একবার সেবা দিতে যাচ্ছেন। একই পরিবারে আবার পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী সেবা দিতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে আছেন সিএইচসিপি, তাঁর কাজ মূলত ওষুধ বিতরণ করা। এই তিনজনের সেবা দানের বিষয়টি সমন্বয় করার কথা ভাবছে সরকার, যেন একই কাজ দুজন না করেন।
কমিশন সুপারিশে বলেছে, কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ বিক্রির সুযোগ রাখতে হবে। পাশাপাশি যেসব ওষুধ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কেনা যায়, সেসব ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিকে বিক্রির ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে জরুরি প্রয়োজনে মানুষের ওষুধ পেতে বিলম্ব না হয়।