পাল্টাপাল্টি হামলায় উত্তপ্ত চট্টগ্রাম নগর
প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রা কর্মসূচি বুধবার শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে বিএনপি। আগের দিন মঙ্গলবার নগরের পুরোনো রেলস্টেশন চত্বরে শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশ করে নগর আওয়ামী লীগ। এত দিন দুটি দলই বিভিন্ন কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ পাথর ছুড়ে মারা ও ভাঙচুরের ঘটনা কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠল চট্টগ্রামের রাজনীতি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে।
বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হয়। আধা ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে বিএনপির পদযাত্রা থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়। এরপর সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে ‘জয় বাংলা স্লোগান’ দিয়ে মিছিল নিয়ে নির্বাচনী কার্যালয় থেকে এক কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বিএনপির কার্যালয়ে পাল্টা হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, আওয়ামী যুবলীগ নিজেরা নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা করে নাটক সাজিয়েছে। ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-১০ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
বুধবার বিকেলে নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পদযাত্রা শুরু করেন। প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রাটি নগরের নিউমার্কেট, রেলস্টেশন, টাইগারপাস হয়ে দেওয়ানহাটে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখান থেকে নেতা–কর্মীরা যে যার এলাকায় হেঁটে কিংবা গাড়িতে চড়ে ফিরতে শুরু করেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে নগরের লালখান বাজার এলাকায় পার্শ্ববর্তী উড়ালসড়কের ওপর থেকে এবং পাশের সড়ক থেকে চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর নির্বাচনী কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। কার্যালয়ের পাশের এক দোকানদার প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির পদযাত্রা থেকে ফেরা লোকজনই ইটপাটকেল ছুড়ে মারেন। ওই সময় নৌকার প্রধান কার্যালয়ের বাইরে থাকা তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে দুটিতে মহিউদ্দিন বাচ্চুর পোস্টার লাগানো ছিল। আরেকটি গাড়ি পুলিশের। কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করা হয়। তখন কার্যালয়ের ভেতরে ও আশপাশে থাকা আওয়ামী লীগ, যুবলীগের কর্মীরা ইটপাটকেল ছোড়া লোকজনকে ধাওয়া দেন।
ঘটনাস্থলে থাকা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এরশাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনী কার্যালয়ের পাশে ইস্পাহানি মোড় থেকে ফেরার পথে দেখতে পান, পদযাত্রা থেকে ফেরা কিছু যুবক তাঁদের দলীয় কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছুড়ছেন। উড়ালসড়কের ওপর থেকেও পাথর ছুড়ে মারা হয়। এতে তাঁদের কর্মীরা আহত হন। তাঁরা ওই সময় গাড়ি ভাঙচুর করেন।
মিছিল নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে হামলা
নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুরের খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে জড়ো হতে শুরু করেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ঘটনাস্থলে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ের সামনের সড়কে প্রায় ৫০০ নেতা–কর্মী। বেশির ভাগেরই হাতে ছিল লাঠিসোঁটা। একপর্যায়ে কিছু নেতা–কর্মী ‘সবাই চল, বিএনপি কার্যালয়ে হামলা করতে হবে’ বলেন। ওই সময় তাঁদের পেছনে প্রায় ৩০০ নেতা–কর্মী লাঠিসোঁঠা নিয়ে এক কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিএনপির কার্যালয়ে গিয়ে পৌঁছান।
তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থাকা বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিভিন্ন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। কয়েকজনের হাতে ধারালো দেশীয় অস্ত্র (কিরিচ) দেখা গেছে। ওই সময় কার্যালয়ের সামনের নুর আহমদ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন পথচারীরা। বন্ধ হয়ে যায় আশপাশের দোকানপাট।
মিছিল নিয়ে কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে ভেঙে ভেতরে ঢোকেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। সেখানে থাকা বিভিন্ন ব্যানার, চেয়ার ও টেবিল ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় কার্যালয়ের সামনের আঙিনায় থাকা একটি মোটরসাইকেল। কার্যালয়ের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ–যুবলীগের নেতা–কর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন। ওই সময় তাঁরা কার্যালয়ের সামনে নুর আহমদ সড়কে ব্যানার জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দেন। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। তারা কার্যালয়ের সামনে পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে রাখে। যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারেন।
বিএনপির কার্যালয়ের সামনের আঙিনায় থাকা ভাঙারি ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে কার্যালয়ে লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢোকেন। ওই সময় তিনি কার্যালয়ের সামনে ছিলেন। ছুড়ে মারা চেয়ারের আঘাতে তিনি আহত হন। একপর্যায়ে কার্যালয়ের ভেতরে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করা হলে পুলিশ এসে তাঁদের বের করে দেয়।
এদিকে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতা–কর্মীরা সড়কে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এর মধ্যে সেখানে চলে আসে তাঁদের আরও দুটি মিছিল। তাঁরা বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশ তাঁদের দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। ঘটনাস্থলে মোতায়েন হয় অতিরিক্ত তিন প্লাটুন পুলিশ। বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আনা হয় পুলিশের দুটি সাঁজোয়া যান।
সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটের দিকে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে যান আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীরা। এরপর স্বাভাবিক হয় যান চলাচল।
ভাঙচুর দেখতে কার্যালয়ে বিএনপির নেতারা
সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে কার্যালয়ে আসেন বিএনপির নেতা–কর্মীরা। ওই সময় নগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম বিএনপির কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা–কর্মীদের হামলা এই প্রথমবারের মতো। তাঁরা কার্যালয়ের ভেতরে বাইরে যে তাণ্ডব চালিয়েছেন, তা অবর্ণনীয়। বুধবার বিএনপির পদযাত্রায় লাখো মানুষ অংশ নিয়েছেন। শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা শেষ হয়েছে, নগরের কোথাও কিছু হয়নি। বিএনপি কেন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালাবে? আওয়ামী লীগের লোকজনই তাঁদের কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছেন। উল্টো পদযাত্রা শেষে ফেরার পথে বিএনপির ৮–১০ কর্মীকে হামলা চালিয়ে আহত করেছেন তাঁরা। বিএনপি কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় তাঁরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিএনপিকে দায়ী করছে আওয়ামী লীগ
বিএনপির পদযাত্রা থেকে পরিকল্পিতভাবে তাঁর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর ও হামলা করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু। এ ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ইশারা ছিল বলেও তাঁর অভিযোগ। লালখান বাজার এলাকায় প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে বুধবার রাত আটটায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন। হামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী এবং নিরাপত্তাকর্মীসহ ১৯ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু। এ ছাড়া প্রাইভেট কার, নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা ট্রাক, ১০টি মোটরসাইকেলসহ মোট ১৪টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অভিযোগ।
মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাহেব পদযাত্রা যাওয়ার সময় আমাদের নির্বাচন অফিস আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের নিরাপত্তা প্রহরীরা দেখেছে। আমাদের ভিডিও ফুটেজও আছে। আমীর খসরু মাহমুদের নির্দেশে আমাদের কার্যালয়ে হামলা করা হয়েছে।’
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ক্যাম্প ও বিএনপির কার্যালয়ে যাঁরা হামলা চালিয়েছেন, তাঁদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে দুটি ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা যায়নি।