নির্মাণের দুই বছর পরও চালু হয়নি ছাতক সিমেন্টের নতুন কারখানা
রোপওয়ের মাধ্যমে কারখানায় চুনাপাথর আনা হয়।
বাংলাদেশ অংশের রোপওয়ে ১১ কিলোমিটার, ভারত অংশে ছয় কিলোমিটার।
বাংলাদেশ অংশের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে, ভারত অংশের কাজ শুরু হয়নি।
ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের নতুন কারখানার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে। তবে নির্মাণের দুই বছর পরও সরকারি কারখানাটি উৎপাদনে যেতে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত ভারত অংশে রোপওয়ে (চুনাপাথর আনার পথ) নির্মাণের অনুমতি না পাওয়া এবং গ্যাসলাইন নির্মাণ না করতে পারায় উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না। এতে একদিকে সম্পদ–জনবলের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে বসিয়ে রাখায় নতুন কারাখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ছাতক সিমেন্ট কারখানার প্রধান কাঁচামাল চুনাপাথর। রোপওয়ের মাধ্যমে ভারত থেকে চুনাপাথর আনা হয়। বাংলাদেশ–ভারত মিলিয়ে এই রোপওয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের ১১ কিলোমিটার নির্মাণকাজ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ভারত অংশের প্রায় ছয় কিলোমিটার রোপওয়ে নির্মাণের অনুমতি পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ভারত অংশের রোপওয়ে নির্মাণের জন্য দেশটির একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ছাতক কারখানা থেকে চুক্তির খসড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
চীনা ঠিকাদারকে অনুরোধ করা হয়েছে, ভারত অংশের রোপওয়ে নির্মাণের কাজটা ভারতীয় কোম্পানিকে দিতে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি রাজি হয়েছে।
‘ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদনপদ্ধতি ওয়েট প্রসেস থেকে ড্রাই প্রসেসে রূপান্তরকরণ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। এর আওতায় কারখানার পাশাপাশি রোপওয়ে নির্মাণ করার কথা। এটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের নানজিং সি–হোপ সিমেন্ট ইনঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড।
কারখানা ও প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নতুন কারখানার পাশাপাশি বাংলাদেশ অংশের রোপওয়ে নির্মাণ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি; কিন্তু ভারত অংশের নির্মাণকাজ চীনের কোম্পানি দিয়ে করাতে চায়নি ভারত সরকার। মূলত এ কারণে ভারত অংশের রোপওয়ে নির্মাণের বিষয়টি ঝুলে যায়।
সূত্রমতে, ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্ট (উপচুক্তি) দিয়ে রোপওয়ে নির্মাণে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে ভারত সরকারেরও সম্মতি রয়েছে। ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোমোরাহ লাইমস্টোন মাইনিং কোম্পানিকে (কেএলএমসি) এই কাজ দেওয়ার আলোচনা চলছে। ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিকে চুনাপাথর সরবরাহ করে এই কেএলএমসি।
ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুর রহমান গত ১৮ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, চীনা ঠিকাদারকে অনুরোধ করা হয়েছে, ভারত অংশের রোপওয়ে নির্মাণের কাজটা ভারতীয় কোম্পানিকে দিতে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি রাজি হয়েছে।
গ্যাসলাইন নির্মিত হয়নি, বাড়ছে মেয়াদ
বিসিআইসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ছাতক সিমেন্ট কারখানা দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ সিমেন্ট কারখানা। যেখানে ক্লিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদন করা হয়। সিমেন্ট উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ক্লিংকার। চুনাপাথর ও মাটি থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম, সিলিকা, অ্যালুমিনা, আয়রন ইত্যাদিকে বিভিন্ন তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ক্লিংকার প্রস্তুত করা হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ছাতকের নতুন কারখানা চালু হলে দৈনিক ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ক্লিংকার এবং ৫০০ মেট্রিক টন সিমেন্ট উৎপাদন করা সম্ভব, যা আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি। এতে আগের চেয়ে বেশি গ্যাস লাগবে।
জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড এত দিন ছাতক অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের মূল লাইন থেকে কারখানাটিতে গ্যাস সরবরাহ করত। যেহেতু আগের চেয়ে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন হবে, তাই নতুন গ্যাসলাইন তৈরি করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিলেট থেকে কারখানা পর্যন্ত ৪৩ কিলোমিটার গ্যাসলাইন নির্মাণ করতে হবে। প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় গ্যাসলাইন নির্মাণের বিষয়টি যুক্ত ছিল না।
গ্যাসলাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে প্রকল্প দপ্তর জানিয়েছে, গ্যাসলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালে প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৬৬৭ কোটি টাকা। পরে সংশোধনী এনে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৮৯০ কোটি টাকা। এরপর আবার ব্যয় বাড়ানোর পর এটি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায়। প্রকল্পের কাজ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়াতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে প্রকল্প দপ্তর।
চালু নিয়ে অনিশ্চয়তা
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা ছাতক উপজেলায় সুরমা নদীর তীরে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাতক সিমেন্ট কারখানা। প্রতিষ্ঠার সময় নাম ছিল ‘আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি’। এটি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় কারখানাটি মালিক ‘ছেড়ে যান’। ১৯৬৬ সালে কারখানাটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আসে। পরে ১৯৮২ সালে এটির নিয়ন্ত্রণ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)।
কারখানা ও প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে ভারত সরকার ছাতক সিমেন্ট কারখানাকে চুনাপাথর সরবরাহ করা কেএলএমসির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। চুনাপাথর না পেয়ে ২০২১ সালের মে মাসে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত পুরোনো ও নতুন উভয় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ আছে। ফলে রোপওয়ে নির্মাণ করা হলেও কেএলএমসির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় ছাতক সিমেন্ট কারখানা চালু হওয়া নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।
অবশ্য কারখানার কর্মকর্তারা বলছেন, কেএলএমসির মাইনিংয়ের (পাথর উত্তোলন) ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। তারা রোপওয়ে নির্মাণ করতে পারবে।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কেএলএমসি জমি লিজ নেওয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে। তা ছাড়া রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়ে গেলে নিষেধাজ্ঞার কারণে চুনাপাথর সরবরাহ বন্ধ থাকবে না। কারণ, কেএলএমসি বলেছে, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনে তারা সরবরাহ করবে।
ধুলা জমছে নতুন কারখানায়
সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে ছাতক উপজেলা সদরের সুরমা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ছাতক সিমেন্ট কারখানা।
গত ৮ এপ্রিল সরেজমিন দেখা যায়, নদীর পাড়ে কারখানা থেকে ক্লিংকার খালাসের জন্য একটি জেটি রয়েছে। কনভেয়ার বেল্ট হয়ে কারখানার থেকে সরাসরি সিমেন্টের বস্তা একেবারে নদীতে এসে নৌযানে পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পুরোনো কনভেয়ার বেল্টের পাশে নতুন করে কনভেয়ার বেল্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
নদীর তীর থেকে কনভেয়ার বেল্ট ধরে আধা কিলোমিটারের মতো এগোলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার মূল ফটক। সড়কের দুপাশে কারখানার প্রশাসনিক ভবন, ব্যাংক, আবাসিক ও অতিথি ভবনসহ কিছু ভবন রয়েছে।
কারখানার ভেতরটা অনেকটাই সুনসান। পুরোনো যন্ত্রপাতি পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। পুরোনো কারখানার স্থাপনাগুলো পশ্চিম দিকে। পূর্বদিকে নতুন কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বড় বড় যন্ত্রপাতি, নতুন স্থাপনা। তবে এসব অলস পড়ে আছে। ওপরে ধুলোবালি জমেছে।
কারখানার উত্তর দিকে একেবারে শেষ প্রান্তে রোপওয়ে স্টেশনের নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ভারত থেকে চুনাপাথর এনে এখানে মজুত করা হবে।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ছাতকের পাশেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লাফার্জ সিমেন্ট কারাখানায় উৎপাদন চলছে। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠানটি অলস পড়ে আছে।