নারীর প্রতি বৈষম্য রোধে এত আইন, তবু কেন বৈষম্য
বাংলাদেশে শুধু নারীর প্রতি বৈষম্য রোধে একাধিক আইন রয়েছে। এতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের সার্বিক আইনকাঠামোতে বৈষম্যের শিকার নারীর জন্য যথেষ্ট সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের আইনকাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। নারীকে উপেক্ষা করেই নারীর জন্য তৈরি হয়েছে একাধিক আইন ও নীতিমালা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের যথাযথ পর্যালোচনা না করেই একের পর এক আইন প্রণয়ন আর নারীর জন্য প্রণীত আইনে নারীর মতামতকেই অন্তর্ভুক্ত না করার ফল হলো আইনে নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থান আর আইন প্রয়োগের দুর্বল কাঠামো।
বাংলাদেশে নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থানের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহতা এবং সহিংসতা বন্ধে প্রচলিত আইনকাঠামোর ব্যর্থতা। খুব সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে স্বামীর দ্বারা শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হন। অথচ বাংলাদেশের আইনকাঠামোয় পারিবারিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয় না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো একটি সুনির্দিষ্ট আইনে যা কিনা পৃথক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে নারীর প্রতি সহিংসতার বিচার করার বিধান করেছে, পারিবারিক সহিংসতাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখনো শুধু যৌতুকসংক্রান্ত নির্যাতনের ক্ষেত্রেই স্বামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা সম্ভব, অন্য পারিবারিক সহিংসতা স্পষ্টতই ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের বাইরে।
আমাদের আইনকাঠামোয় নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সবচেয়ে বেশি বৈষম্যমূলক বিধানটি হলো কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়া। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা এখনো বলবৎ আছে। এখানে বলা আছে, ১৩ বছর বয়সী মেয়েশিশুও স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে প্রথমে এই যৌনসম্মতির বয়সসীমা ছিল ১০ বছর, যা যেকোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত শিশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। অর্থাৎ ১০ বছর বয়সের পরে কোনো বিবাহিত মেয়েশিশু তার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করতে পারত না। কেননা ধরে নেওয়া হতো বিয়ের মাধ্যমে তার যৌন সম্পর্কে সম্মতি রয়েছে।
পরে ব্রিটিশ ভারতে একাধিক বর্বরোচিত ঘটনায় নববিবাহিত কন্যাশিশু প্রাপ্তবয়স্ক স্বামীর মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যায়। কিন্তু হত্যাকারী স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা যায় না। সেসব ঘটনার সূত্র ধরে ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের আন্দোলনের মুখে বিবাহিত কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ধর্ষণের ধারায় যৌন সম্পর্কে সম্মতির বয়সসীমা ১০ থেকে বাড়িয়ে প্রথমে ১২ ও পরে ১৩ করা হয়েছিল। চিকিৎসক সমাজসহ অনেক পক্ষই তখন দাবি তুলেছিল, এই বয়সসীমা আরও বাড়িয়ে ১৬ করা হোক। দুঃখজনক হলো, ১০০ বছর পরেও বিবাহিত মেয়েশিশুর জন্য সেই বয়সসীমা ১৩ বছরই রয়ে গেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌনসম্মতির বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ বছর, কিন্তু এই বিধান আবার স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সে ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ১৩ বছরের সীমাই প্রযোজ্য।
ক্ষতিগ্রস্তকেই শাস্তি
শিশুবিবাহ আইনেও বেশ কিছু বৈষম্যমূলক ধারা রয়েছে। ২০১৭ সালে নতুন করে প্রণীত এই আইনে বিবাহের শিকার শিশুর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, অথচ আইনটি নিজেই শিশুবিবাহের শিকার শিশুকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ ব্যক্তির জন্য আইন করা হয়েছে, আইনে তাকেই শাস্তি প্রদান করার বিধান রাখা হয়েছে! এ ছাড়া এই আইনে নারী ও পুরুষের বিয়ের ক্ষেত্রে বৈধ বয়সসীমা যথাক্রমে ১৮ ও ২১ বছর করা হয়েছে। একজন নারী ১৮ বছর বয়সে বিয়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হলেও ১৮ বছরের একজন পুরুষকে কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক মনে করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো আইনি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
নারীকে সামাজিক কুপ্রথা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আরও রয়েছে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮। এই আইনটি ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন বাতিল করে নতুনভাবে করা হয়। তবে এটি স্পষ্ট নয় যে কেন ১৯৮০ সালের আইনটিতে কিছু সংশোধন না করে নতুন আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজন হলো। দুটি আইনের মধ্যে কিছু সংশোধন আর সংযোজন ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। বরং ১৯৮০ সালের আইনটিতে ‘যৌতুক’–এর যে বৈষম্যমূলক সংজ্ঞার বিধান ছিল, তা আরও বেশি জটিল করে নতুন আইনে যৌতুককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যৌতুকের আইনি সংজ্ঞায় কোনো আর্থিক দাবিদাওয়াকে যৌতুক হিসেবে প্রমাণ করতে গেলে একজন বাদীকে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, তাতে যৌতুকের শিকার কেউ যদিবা প্রমাণও করতে পারেন যে তাঁর স্বামী প্রতিনিয়ত অর্থ বা সম্পত্তির দাবি করছেন, তবে দাবি করা সেই অর্থ বা সম্পদ যে এই আইন অনুযায়ী ‘যৌতুক’ হবে, সেটি প্রমাণ করা দুরূহ।
শুধু তা–ই নয়, আইনে যৌতুক নেওয়ার শাস্তির মাত্রাও একই রাখা হয়েছে, অথচ যে যৌতুকপ্রথা বন্ধের উদ্দেশ্যে এই আইন করা হয়েছে, সেই প্রথার শিকার যে মূলত কনেপক্ষের পরিবার এবং পরবর্তী সময়ে বিবাহিত স্ত্রী, সেই বাস্তবতাকেই আইনে উপেক্ষা করা হয়েছে।
নারীর প্রতি বৈষম্যের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ধর্মীয় পারিবারিক আইনগুলোতে বিদ্যমান নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বিধানগুলোর প্রচলিত ব্যাখ্যায়। পারিবারিক আইনে বৈষম্য নিয়ে কথা হয় অনেক, কিন্তু আইন সংস্কারের প্রশ্নে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকে দৃশ্যমান নিষ্ক্রিয়তা। বিশ্বের অনেক দেশে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য প্রচলিত ধর্মীয় পারিবারিক আইনের কাঠামোয় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেই ইতিবাচক সংস্কারগুলো আমাদের পারিবারিক আইন পরিবর্তনের আলোচনায় অনেকটাই উপেক্ষিত রয়ে যায়। যেমন এখনো ১৮৯০ সালের গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট দ্বারা নির্ধারণ করা হয় সন্তানের অভিভাবকত্ব। সেখানে স্পষ্টতই ধর্মীয় পারিবারিক আইনের অভিভাবকত্ব–সংক্রান্ত লিঙ্গবৈষম্যমূলক প্রচলিত ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যদিও বিগত দশকে আমাদের উচ্চ আদালত একাধিক সিদ্ধান্তে এটি স্পষ্ট করেছেন যে সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণে শিশুর লৈঙ্গিক পরিচয় বা বয়স নয়, একমাত্র বিবেচ্য হবে তার সর্বোত্তম স্বার্থ। শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করা বাংলাদেশের অনুস্বাক্ষরকৃত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের মূল নীতির সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। একাধিক মামলায় আমাদের উচ্চ আদালতও তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। সন্তানের অভিভাবকত্ব নির্ধারণে তাই প্রয়োজন নতুন আইন, যেখানে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থই প্রধানতম বিবেচ্য হিসেবে আইনে স্পষ্ট করা থাকবে।
আরও কিছু বৈষম্যমূলক আইন
পারিবারিক আইনের বেশ কটি বৈষম্যমূলক বিষয়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হলো হিন্দু নারীর বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার। ২০২৫ সালে এসেও একজন হিন্দু নারী তাঁর স্বামীর সঙ্গে বৈধভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন না। অন্যদিকে হিন্দু পুরুষের যেহেতু প্রচলিত সনাতনী রীতিতে বহুবিবাহ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই, তাই বিবাহবিচ্ছেদ না করার মতো প্রাচীন প্রথার প্রয়োগে একজন হিন্দু পুরুষের ভোগান্তি হয় না, বরং মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হন একজন হিন্দু নারী।
বহুবিবাহ আর তালাকের ক্ষেত্রে মুসলিম নারীও অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক আইন প্রয়োগের শিকার হন। আদালতে পারিবারিক আইনের বেশির ভাগ বিষয়ই যেহেতু ধর্মীয় রীতিনীতির প্রচলিত ব্যাখ্যা দিয়েই নির্ধারিত হয়, ধর্মীয় সংবেদনশীলতার প্রশ্নটি তাই অনেক সময় পারিবারিক আইনের সংস্কারের ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করা হয়। নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে আইন সংস্কার করতে হলে ধর্মীয় নীতির সংবেদনশীলতাকে বিবেচনায় রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আলোকে রাষ্ট্রকে সার্বিকভাবে আইন পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। পারিবারিক আইনের বৈষম্য দূর না করে নারীর সম–অধিকার আদায়ের কোনো আইন সংস্কারই যথার্থ হবে না।
নারীর প্রতি সহিংসতাসংক্রান্ত আইন এবং পারিবারিক আইনের বাইরেও আমাদের প্রচলিত আইনকাঠামোর অনেক জায়গাতেই সরাসরি নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বিধান রয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা খুবই সীমিত। যেমন বাংলাদেশের শ্রম আইনের ৮৭ ধারায় একজন কিশোর শ্রমিক অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুশ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য বিপজ্জনক কাজের যে বাধানিষেধ আছে, তা একজন নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ একজন নারী শ্রমিকের কর্মক্ষমতা যাচাই-বাছাই না করেই, তাঁর সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, তাঁর কাজের সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলের অনেকগুলো আইন বাংলাদেশে প্রযোজ্য। ১০০ বছর আগের এই আইনগুলোতে একজন ‘বিবাহিত নারী’কে কিছু ক্ষেত্রে সীমিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী একজন বিবাহিত নারী যথাযথ ট্রাস্টি হতে পারবেন না।
এভাবে পারিবারিক আইন থেকে শুরু করে শ্রম আইন, ফৌজদারি আইন থেকে শুরু করে সম্পত্তির অধিকারসংক্রান্ত আইন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি একাধিক বৈষম্যমূলক বিধান রয়েছে, যা সংবিধানের সমতার নীতি ও আন্তর্জাতিক আইনে দায়বদ্ধতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় নারীকে অন্তর্ভুক্ত না করে আইনকাঠামোতে নারীর অবস্থানের উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়।
আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আইনের মূল অংশীদারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে অর্থাৎ যাদের ওপর আইনটির যথাযথ প্রয়োগ নির্ভর করে, তা প্রণয়ন ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কী পরিবর্তন হওয়া উচিত, সেই পর্যালোচনায় তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর থেকে শুরু করে বিচারপ্রার্থী নারীর মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কোনো আইন প্রণয়ন করার পাশাপাশি আইনটি প্রয়োগের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগের পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যালোচনা করার সরকারি উদ্যোগকেও একই সঙ্গে কার্যকর করতে হবে। নয়তো নতুন আইন শুধুই কাগজে-কলমে রয়ে যাবে, ন্যায়বিচার যাদের প্রয়োজন, তারা আইনের সুরক্ষার বাইরেই থেকে যাবে।
তাসলিমা ইয়াসমীন : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়