১১ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে স্বাস্থ্য ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত, পরে বাদ

রাজধানীর মিরপুর সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আল এমরান আলী অবসরে যান ২০২০ সালের ২০ মার্চ। অবসরে যাওয়ার তিন বছরের বেশি সময় পর ১০ মে তাঁকে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। যদিও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে তাঁর স্বাস্থ্য ক্যাডারভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে তিনি এখন চাকরিতেও নেই।

উন্নয়ন খাতের চিকিৎসকদের বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে আত্তীকরণ (এনক্যাডারমেন্ট) করা নিয়ে এমন কাণ্ড ঘটেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। অবশ্য স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকদের প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত ‘অনিয়ম ও ভুলে ভরা’ ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৪৫৯ চিকিৎসককে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করে ১০ মে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। এসব চিকিৎসক বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন খাতে (সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে) যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আল এমরান আলীসহ হোমিওপ্যাথিকের ডিগ্রিধারী অন্তত ১১ জনের নাম থাকায় প্রজ্ঞাপনটি বাতিলের দাবি তোলেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকেরা। প্রজ্ঞাপন জারির পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর বিরুদ্ধে সরব হন তাঁরা। অভিযোগ তোলেন, আত্তীকরণের নামে অনিয়ম করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কথা হয় বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, হোমিওপ্যাথিক ও ইউনানি ডিগ্রিধারীদের স্বাস্থ্য ক্যাডারে আসার সুযোগ নেই। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রি, যেটি তাঁদের নেই। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকেরা নামের আগে ‘ডাক্তার’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন না, উচ্চ আদালত এমন রায়ও দিয়েছেন। তবু কীভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য ক্যাডারে আত্তীকরণ করা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।

শর্ষের ভেতরেই ভূত আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ তালিকা মন্ত্রণালয়ে গেছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারে যাঁদের যাওয়ার যোগ্যতাই নেই, তাঁদের নাম কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো, এটা তদন্ত করে বের করতে হবে। এর পেছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় না আনলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে। এই জন্য এ অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত করা জরুরি।
ডা. নিরুপম দাস, সদস্য, গভর্নিং বোর্ড, বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন

চিকিৎসকদের প্রতিবাদের মুখে প্রজ্ঞাপনটি বাতিলের পর ১৫ মে নতুন করে ৩৮৫ জনকে স্বাস্থ্য ক্যাডারে আত্তীকরণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অর্থাৎ বাদ পড়েন ৭৪ জন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। এই ভুল সংশোধন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর বাকি যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা এখন চাকরিতে নেই। সবাই অবসরে গেছেন।

‘সবাই জানতেন আমরা হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রিধারী’

মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা সংশোধিত আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডিগ্রিধারী ১১ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন আল এমরান আলী, কামাল উদ্দিন, মনজুরুল হক, জেবুন্নেছা, রাহেনা আক্তার, সৈয়দ মাহবুব আলম, মোহাম্মদ আবদুর রহিম, আক্তার জাহান, অসীম কৃষ্ণ চৌধুরী, আবুল কালাম ও শাহীন আক্তার জাহান। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন এখন অবসরে।

আল এমরান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি চাকরি থেকে তিন বছর আগে অবসরে গেছি। কেন আমাকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, আবার কেনই–বা বাদ দেওয়া হলো, তা বুঝতে পারিনি।’

একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিন্ডিকেট ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তালিকা করেছে। তাদের কাছে সবার তথ্য আছে। কারা হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রিধারী, কারা অবসরে গেছেন, সব তথ্যই তাদের কাছে আছে। তাই এ তালিকায় হোমিওপ্যাথিক ও অবসরপ্রাপ্তরা ঢুকে পড়ার বিষয়টি সিন্ডিকেট ছাড়া সম্ভব নয়।

যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হতে কেন আবেদন করেছিলেন, এমন প্রশ্নে আল এমরান আলী বলেন, ‘আমরা তো গোপনে আবেদন করিনি। প্রকাশ্যেই আবেদন করেছি। আমরা যে হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রিধারী চিকিৎসক, সেটি তো সবাই জানতেন। যাঁরা যাচাই-বাছাই করলেন, তাঁরা বিষয়টি দেখেননি কেন?’ স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকেরা প্রফেশনাল জেলাসি (পেশাগত ঈর্ষা) থেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের মানতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব জাকিয়া পারভীন গত সপ্তাহে তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এটি সংশোধন করা হয়েছে। তবে কীভাবে এমন ভুল হলো, এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

‘শর্ষের ভেতরেই ভূত আছে’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, নন-ক্যাডার থেকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করতে ২০১৪ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ৯ বছরের মাথায় এসে উন্নয়ন খাত থেকে ৩৭৯ জনকে স্বাস্থ্য ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হলো।

স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকেরা বলেছেন, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছাড়া বাদ পড়া ৬৩ জন চাকরিজীবনে বিভিন্ন সময়ে সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ এখন চাকরিতে নেই। সে কারণে তাঁদের ক্যাডারভুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

তারপরও কীভাবে তাঁদের ক্যাডারভুক্ত করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন তুলে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, কারা এই অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত, তা খতিয়ে দেখা উচিত। একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিন্ডিকেট ছাড়া এ কাজ করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তালিকা করেছে। তাদের কাছে সবার তথ্য আছে। কারা হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রিধারী, কারা অবসরে গেছেন, সব তথ্যই তাদের কাছে আছে। তাই এ তালিকায় হোমিওপ্যাথিক ও অবসরপ্রাপ্তরা ঢুকে পড়ার বিষয়টি সিন্ডিকেট ছাড়া সম্ভব নয়।

এ ঘটনাকে স্বাভাবিক ও অনিচ্ছাকৃত ভুল বলতে নারাজ বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য ডা. নিরুপম দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শর্ষের ভেতরেই ভূত আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ তালিকা মন্ত্রণালয়ে গেছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারে যাঁদের যাওয়ার যোগ্যতাই নেই, তাঁদের নাম কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো, এটা তদন্ত করে বের করতে হবে। এর পেছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় না আনলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে। এই জন্য এ অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত করা জরুরি।