সই জাল করে স্বাস্থ্যের প্রশিক্ষণের টাকা লোপাট

রাজধানীর মহাখালীর সরকারি কুষ্ঠ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক সুমন বনিক গত ১৯ অক্টোবর তাঁর অধীন এক কর্মকর্তার কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। এ–সংক্রান্ত চিঠিতে তিনি বলেন, ওই কর্মকর্তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক তারিখে কুষ্ঠবিষয়ক প্রশিক্ষণে রিসোর্স পারসন হিসেবে ছিলেন, আবার একই তারিখে কর্মস্থলেও উপস্থিত ছিলেন—‘এটা আদৌ সম্ভবপর নয়’ উল্লেখ করে দুই দিনের মধ্যে ওই কর্মকর্তাকে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় চিঠিতে।

৫ নভেম্বর সুমন বনিক নিজ কার্যালয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাখ্যা চেয়ে তিনি মোট চারজনকে চিঠি দিয়েছিলেন। চারজনই লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তাঁরা কুষ্ঠবিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণে রিসোর্স পারসন হয়ে দেশের কোথাও যাননি।

কে প্রশিক্ষক হবেন, এর কোনো মানদণ্ড নেই। মানদণ্ড থাকলে এমন সব কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষক হিসেবে দেখানোর সুযোগ থাকত না। আর প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও অনেক মৌলিক সমস্যা আছে, সেগুলো দূর না করলে অনিয়ম-দুর্নীতি চলতেই থাকবে।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

সুমন বনিকের চিঠির জবাবে ২১ অক্টোবর এক চিকিৎসক লিখেছেন, ‘যেসব তারিখে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার নাম (পদবিসহ) রিসোর্স পারসন হিসেবে দেখানো হয়েছে, উল্লিখিত তারিখে আমি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম। প্রশিক্ষণের উপস্থিতি কাগজে যে সই আছে, সে সই আমার নয়। আমার সই জাল করে প্রশিক্ষণের সম্মানী উত্তোলনের বিষয়টির সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আবেদন জানাচ্ছি।’

যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ—এ দুটি রোগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। এর লাইন ডিরেক্টর মাহফুজার রহমান। ৫ নভেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সই জাল করে কুষ্ঠের প্রশিক্ষণের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে—এমন কিছু তিনি জানেন না, এমন কিছু তিনি শোনেননি। তিনি কুষ্ঠ কর্মসূচির ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

লাইন ডিরেক্টর ও কুষ্ঠ কর্মসূচির ব্যবস্থাপকের কার্যালয় একই ভবনে। কুষ্ঠ কর্মসূচির ব্যবস্থাপক আফজালুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী–কর্মকর্তাদের মধ্যে বিবদমান দুটি দল আছে। একটি দল অন্য দলকে হেয় করার জন্য অপবাদ ছড়াচ্ছে। বাস্তবে কোনো অর্থ আত্মসাত হয়নি।

উল্লেখ্য, যক্ষ্মা কর্মসূচিতে ২০১৭ সালে আফজালুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, সই জাল করে মোট ৫১ লাখ ৪২ হাজার ২৮০ টাকা নিয়েছেন কুষ্ঠবিষয়ক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা পাঁচ ব্যক্তি। অন্যদিকে ছয় কর্মকর্তার সই জাল করা হয়েছে। তাঁদের চারজন কাজ করেন কুষ্ঠ হাসপাতালে, বাকি দুজন কাজ করেন যক্ষ্মা কর্মসূচিতে।

জাল সইয়ে অর্থ আত্মসাৎ

নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কুষ্ঠবিষয়ক প্রশিক্ষণ হয় গত ২৯ ও ৩০ আগস্ট। রিসোর্স পারসন হিসেবে সম্মানী নিয়েছেন ছয়জন। রসিদে তাঁদের সই আছে। ৫ জন নিয়েছেন ১০ হাজার ৪০ টাকা করে, ১ জন নিয়েছেন ৬ হাজার টাকা।

তাঁদের একজন নারী কর্মকর্তা। তিনি কাজ করেন জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে, পদবি কর্মসূচি মূল্যায়ন কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কুষ্ঠের কোনো প্রশিক্ষণে যাননি।

তবে সম্মানী গ্রহণের রসিদে তাঁর নাম ও সই আছে। কাগজে তাঁর নাম ও সই দেখানোর পর তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, নাম তিনি লিখেননি, এই সইও তাঁর নয়। তবে তিনি অবাক হয়ে এ–ও বলেন, ‘সইটা আমার সইয়ের কাছাকাছি।’

প্রায় একই কথা বলেন আরেক কর্মকর্তা। তিনি জানান, যে সই তিনি দেখছেন, সেই সই তাঁর নয়, তিনি এই সই করেননি। সম্মানী নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে, কুষ্ঠ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ২৪টি প্রশিক্ষণে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণ থেকে ১০ হাজার ৪০ টাকা করে রিসোর্স পারসনের সম্মানী বাবদ নিয়েছেন। এ হিসাবে তিনি নিয়েছেন মোট ২ লাখ ৪০ হাজার ৯৬০ টাকা। ওই কর্মকর্তা কুষ্ঠ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক সুমন বনিককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, সই তাঁর নয়। কোনো প্রশিক্ষণে তিনি ছিলেন না। তিনি কোনো সম্মানী নেননি।

দেশে কুষ্ঠ রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমে এসেছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ অনেকটাই সফল হয়েছে। কুষ্ঠ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে বিদেশি সহায়তা অনেকটা কমেছে। এ খাতে বরাদ্দ করা অর্থ ঠিকভাবে খরচ হলে দেশে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা আরও কমে আসত বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

আরও পড়ুন

একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, সই জাল করে মোট ৫১ লাখ ৪২ হাজার ২৮০ টাকা নিয়েছেন কুষ্ঠবিষয়ক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা পাঁচ ব্যক্তি। অন্যদিকে ছয় কর্মকর্তার সই জাল করা হয়েছে। তাঁদের চারজন কাজ করেন কুষ্ঠ হাসপাতালে। বাকি দুজন কাজ করেন যক্ষ্মা কর্মসূচিতে।

এ বছর জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫১টি প্রশিক্ষণ হয়। এসব প্রশিক্ষণ আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলায় চিঠি দিয়েছিলেন কুষ্ঠ কর্মসূচির ব্যবস্থাপক আফজালুর রহমান। কাগজপত্রে দেখা যায়, সম্মানী অনুমোদন দেওয়ার কাগজপত্রেও সই করেছেন তিনি।

প্রশিক্ষণকে ঘিরে দুর্নীতির এই ‘চর্চা’ চলছে বছরের পর বছর। তবে এসব বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কারও কারও অভিযোগ, প্রশিক্ষণের নামে দুর্নীতি আরও বেড়েছে।

আফজালুর রহমানের বিরুদ্ধে এর আগেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৭ সালের আগে তিনি গ্লোবাল ফান্ডের অর্থসহায়তায় পরিচালিত যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে দায়িত্বরত ছিলেন। গ্লোবাল ফান্ডের ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, যক্ষ্মা কর্মসূচির ৩ কর্মকর্তা ৭৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৮০ টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তালিকায় ৩ নম্বরে ছিল আফজালুর রহমানের নাম।

অতীতের অভিযোগের বিষয়ে আফজালুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই অভিযোগ মিটে গেছে। তবে এ–সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তাঁর কাছে নেই।

আরও পড়ুন

মৌলিক সমস্যাগুলো দূর করতে হবে

স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে আর্থিক দুর্নীতির সমস্যাটি পুরোনো। প্রশিক্ষণ না করেই প্রশিক্ষণ হয়েছে, এমন দাবি করা হয়। এ জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, এমন ভুয়া ব্যক্তি এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, এমন ভুয়া ব্যক্তির তালিকা তৈরি করা হয়। বানানো হয় ভুয়া বিল-ভাউচার। এমনও দেখা গেছে, একজন প্রশিক্ষক একই দিনে দেশের দুই প্রান্তের দুই জেলায় অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে উপস্থিত ছিলেন। প্রশিক্ষণকে ঘিরে দুর্নীতির এই ‘চর্চা’ চলছে বছরের পর বছর। তবে এসব বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কারও কারও অভিযোগ, প্রশিক্ষণের নামে দুর্নীতি আরও বেড়েছে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের তদন্ত ও তদন্তে কেউ দোষী হলে তাঁকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘কে প্রশিক্ষক হবেন, এর কোনো মানদণ্ড নেই। মানদণ্ড থাকলে এমন সব কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষক হিসেবে দেখানোর সুযোগ থাকত না। আর প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও অনেক মৌলিক সমস্যা আছে, সেগুলো দূর না করলে অনিয়ম–দুর্নীতি চলতেই থাকবে।’

আরও পড়ুন