জনবল নিয়োগে শিশু সুরক্ষার কোটি টাকা ভাতা কেটে নেওয়া হলো  

দুটি পদে ৩১০ জন নিয়োগে ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। সেই নিয়োগ নিয়েও আছে অনিয়মের অভিযোগ।

শিশুর প্রতি অবহেলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রকল্পটির উদ্দেশ্য। প্রকল্পের আওতায় বাল্যবিবাহ রোধ, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম নিরসন, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া রোধে শর্ত সাপেক্ষে শিশু সুরক্ষা ভাতা দেওয়ার কথাও বলা আছে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩৩ কোটি টাকার বেশি।

তবে প্রকল্পের দুটি পদে ৩১০ জন নিয়োগে আড়াই কোটি টাকার সংস্থান করতে গিয়ে শিশু সুরক্ষা ভাতা থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে এক কোটি টাকা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) ২য় পর্যায়’ প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটেছে।

এ ধরনের প্রকল্পে দেখা যায়, জনবল খাতেই সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যায়। জনবল নিয়োগে অনিয়মও হয়। এই প্রকল্পের জনবল খাতে অর্থসংস্থান না থাকার মানে হচ্ছে, প্রকল্পটি যথাযথভাবে প্রণীত হয়নি। 
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন

সরকারি অর্থায়ন (জিওবি) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের অনুদানে পরিচালিত হচ্ছে প্রকল্পটি। দ্বিতীয় পর্যায়ের এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ২৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বাকি টাকা ওই সংস্থার প্রকল্প অনুদান।

সিএসপিবি প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চলে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ে এটির মেয়াদ ২০১৭ সালের জুলাই থেকে চলতি ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২৬ জেলার ৫২ উপজেলা ও ১১টি সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যার লক্ষ্য, এ বছরের মধ্যে ১০ লাখ শিশু ও কমিউনিটির লোকজনের জন্য শিশুবান্ধব সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়ন ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা।

প্রকল্পের আওতায় গত বছরের জুন মাসে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটে নির্মিত একটি অস্থায়ী কেন্দ্রে গিয়ে সুবিধাবঞ্চিত দেড় ডজন শিশুর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের দেখা হয়েছিল। এদের কেউ লঞ্চে খাবার বিক্রি করে, কারও মা–বাবা শ্রমজীবী। মা–বাবার অনুপস্থিতির সময় কেন্দ্রে অবস্থান করে তারা। দুপুরের খাবার পায়। চলে পড়াশোনা, খেলাধুলাও।

মো. সাফায়েত ইসলাম নামের এক কিশোর সে সময় জানিয়েছিল, বাবার মৃত্যুর পর মা কাঠের দোকানে কাজে দিয়েছিলেন বলে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল সে। এখন লঞ্চে ফেরি করে বেড়ায়। আরও তিন শ্রমজীবী কিশোরের সঙ্গে সে তাঁবু দিয়ে তৈরি কেন্দ্রে থাকে।

সরকারি অর্থায়ন (জিওবি) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের অনুদানে পরিচালিত হচ্ছে প্রকল্পটি। দ্বিতীয় পর্যায়ের এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ২৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বাকি টাকা ওই সংস্থার প্রকল্প অনুদান।

জনবল নিয়োগে ব্যয় সমন্বয়

প্রকল্পের জনবল নিয়োগ পরীক্ষার ব্যয় সংস্থানে গত বছরের ৬ আগস্ট একটি সভার আয়োজন করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন সমাজকল্যাণসচিব জাহাঙ্গীর আলম।

সভায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও আইন) জোবায়দা বেগম জানান, প্রকল্পের সংশোধিত টিএপিপিতে (টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) ৩১০ জন নতুন কর্মী নিয়োগের বিষয় আছে। কিন্তু জনবল নিয়োগ–সংক্রান্ত ব্যয় প্রকল্পের আরটিএপিপিতে বরাদ্দ না থাকায় নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা যাচ্ছে না। প্রকল্পের জিওবি খাতের অব্যয়িত অর্থ থেকে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ২ কোটি ৬১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা চেয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

নিয়োগ পরীক্ষার জন্য এক কোটি টাকা শিশু সুরক্ষা ভাতা থেকে এবং বাকি দেড় কোটি টাকা সভা, সেমিনার ও ওয়ার্কশপ, মূল্য সংযোজন ব্যয় (ভ্যাট), সম্মানী ভাতা থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে।

সিএসপিবি প্রকল্পের প্রথম পর্যায় চলে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ে এটির মেয়াদ ২০১৭ সালের জুলাই থেকে চলতি ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

শিশুদের ভাতা দেওয়া শুরু হয়নি

প্রকল্পের আওতায় শর্ত সাপেক্ষে শিশুদের ভাতা দেওয়া এখনো শুরু হয়নি। শর্ত হচ্ছে, অভিভাবকেরা শিশুর পক্ষে ভাতা নেবেন এ অঙ্গীকার করে যে শিশুকে কাজে না পাঠিয়ে, বাল্যবিবাহ না দিয়ে স্কুলে পাঠাবেন।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক ছিলেন এস এম লাবলুর রহমান। শিশুদের সুরক্ষা ভাতা থেকে অর্থ কেটে নেওয়া প্রসঙ্গে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের জন্য এই জনবলের প্রয়োজন আছে। অন্য কোনো খাত থেকে অর্থ সংস্থান করতে না পেরে শিশুদের সুরক্ষা ভাতা থেকে জনবল নিয়োগে অর্থ কেটে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার ১০ মাস আগে জনবল নিয়োগ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই বছর ধরে জনবল নিয়োগের চেষ্টা হচ্ছিল। অর্থের সংস্থান না হওয়ায় এত দিন নেওয়া যায়নি।

জানা গেছে, ৩১০টি পদের জন্য প্রায় পৌনে ২ লাখ আবেদনপত্র জমা পড়লেও পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন মাত্র ২৭ হাজার। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শেখদী আবদুল্লাহ মোল্লা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ২ হাজার ৫৩৮ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৩৬২ জন। লাবলুর রহমান বলেন, জনবল নিয়োগে দেড় কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। বাকি টাকা জমা আছে।

ইতিমধ্যে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এ নিয়োগ নিয়ে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগও। যেমন সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মচারীদের কয়েকজন স্বজনকে নম্বর বাড়িয়ে পাস করানোর অভিযোগ উঠেছে।

প্রকল্পের এই শেষ সময়ে শিশুদের জন্য ১৭ মাস ভাতা কীভাবে দেওয়া হবে, জানতে চাইলে লাবলুর রহমান বলেন, শিশুদের ভাতা দেওয়ার সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। নতুন প্রকল্প পরিচালক ভাতা দেওয়া শুরু করবেন। গত বছরের জুন থেকে ১৭ মাস হিসাব করে ভাতা দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে নতুন প্রকল্প পরিচালক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (কার্যক্রম অধিশাখা) মো. ছরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। শিশু সুরক্ষার ভাতা কেটে জনবল নিয়োগের বিষয়ে তিনি জানেন না। শিশুদের ভাতা কবে থেকে দেওয়া হবে, সেটাও তাঁকে জানতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্পে দেখা যায়, জনবল খাতেই সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যায়। জনবল নিয়োগে অনিয়মও হয়। এই প্রকল্পের জনবল খাতে অর্থসংস্থান না থাকার মানে হচ্ছে, প্রকল্পটি যথাযথভাবে প্রণীত হয়নি। তিনি মনে করেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এমনিতেই নানা ধরনের বঞ্চনা, বৈষম্য ও অপুষ্টির মধ্যে বাস করে। ফলে তাদের জন্য বরাদ্দ ভাতা জনবল নিয়োগে কেটে নেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।