দুর্যোগসহনীয় না হলে ভবনের কিছুই তো কাজে লাগবে না

‘অপ্রত্যাশিত দুর্যোগে বেশি ঝুঁকিতে কিডনি রোগী: উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে
ছবি: দীপু মালাকার

ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন দুর্যোগে ভবনটিই যদি ধসে যায়, তাহলে ভবনের ভেতরে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার বানানো থেকে শুরু করে কোনো প্রস্তুতিই কাজে লাগবে না। তাই দুর্যোগসহনীয় ভবন তৈরি করতে হবে। দুর্যোগ প্রতিরোধে পূর্বপ্রস্তুতি এবং সচেতন থাকতে হবে।

শনিবার কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘অপ্রত্যাশিত দুর্যোগে বেশি ঝুঁকিতে কিডনি রোগী: উত্তরণে করণীয়’ শিরোনামের এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

৯ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, দেশে ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।  

মিজানুর রহমান সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানের আগুনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস আর আগুন নেভানোর পানির লাইন কাছাকাছি থাকায় তা কোনো কাজে লাগেনি। ভবনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার জানতেন না ভবনের বাসিন্দারা। তাই শুধু সরকারকে দোষারোপ না করে নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। বিভিন্ন আইনকানুন মানতে হবে। কিডনিসহ বিভিন্ন রোগীকে দুর্যোগে করণীয় বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ভবন তৈরির পাশাপাশি ভবনে ফলস সিলিং, অতিরিক্ত আসবাব দিয়ে সাজানো ফ্যাশন হয়ে গেছে। দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে চাইলে এই বিষয়গুলোতে সচেতন থাকতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাম্পসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক এম এ সামাদ। তিনি এক উপস্থাপনায় দুর্যোগে করণীয় নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে করণীয় প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম এ সামাদ বলেন, দুর্যোগসহনীয় হাসপাতাল, ডায়ালাইসিস সেন্টার, আশ্রয়কেন্দ্র ও যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দুর্যোগে কিডনি রোগীদের প্রয়োজনের দিকে নজর রাখতে হবে। জরুরিভাবে রোগীদের স্থানান্তরের ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

অধ্যাপক এম এ সামাদ বলেন, কিডনি রোগীদের জরুরি পরিস্থিতির জন্য কিট প্রস্তুত রাখতে হবে। বিকল্প ডায়ালাইসিস সেন্টার সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা রাখা, সাহায্যকারী নেটওয়ার্ক তৈরি করে রাখা, ডায়ালাইসিস পেতে বিলম্ব হলে সাময়িক খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, যেমন দুর্যোগে রোগীদের পানি কম খেতে হবে, মাছ-মাংস কম খেতে হবে। পটাশিয়ামযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে।

আলোচনায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, তুরস্কে ভূমিকম্পের পর সেখানে যাওয়া বাংলাদেশের উদ্ধারকারী দলের প্রশংসা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০টি কারখানার ৮টিই বাংলাদেশের; অর্থাৎ দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে করণীয় নিয়ে আলোচনার চেয়ে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। দেশে এসব নিয়ে পরিকল্পনার অভাব নেই, তবে মূল চ্যালেঞ্জ হলো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন না হওয়া। যে ভবন, তা বসবাসের উপযোগী, কম ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ, তা সরকারের দায়িত্ব সবুজ, কমলা ও লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া। আর খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ থাকলে মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে পারবে আর জলাধার পানির সংস্থান দেবে, এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।

কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ কিডনি রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, সুপ্ত কিডনি রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। এ জন্য স্ক্রিনিং করতে হবে।

সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম করোনায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, করোনায় তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারছিলেন না সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেবেন কি না। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সাহস দেখিয়েছিলেন বলেই কিডনি প্রতিস্থাপন চলমান রাখতে পেরেছিলেন। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে রোগীদের কাছে ওষুধ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ডায়ালাইসিস সেন্টারসহ সব ব্যবস্থাই করা হলো, কিন্তু যে ভবনে ডায়ালাইসিস সেন্টার, সেই ভবনই যদি ভূমিকম্পে ধসে যায়, তাহলে তা কোনো কাজে লাগবে না। হাসপাতাল ভবন ঝুঁকিমুক্ত হলে তখন অন্যান্য ব্যবস্থাপনা কাজে লাগবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহাম্মেদ খান রানা প্লাজা ধসের উদাহরণ দিয়ে বলেন, তখন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাই দুর্যোগ প্রতিরোধে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে। জরুরি অবস্থার জন্য আলাদা পরিকল্পনা থাকতে হবে। দেশে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স সেন্টার স্থাপন, মোবাইল মেডিকেল হাসপাতাল তৈরি রাখাসহ অন্যান্য উদ্যোগও নিতে হবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালীও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলা এবং যেগুলো সংস্কারযোগ্য, তা সংস্কারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন (লিপু) নিজের ভবনে দুইবার আগুন লাগার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ভবনগুলো দামি হলেও তাতে নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। দুর্যোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভূমিকম্প হলে টেবিলের নিচে আশ্রয় নিতে হবে, ছোটবেলায় শেখা কথাটি কিন্তু সবার মনে থাকে।

গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক নিজামউদ্দিন চৌধুরী, পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদ্‌রোগ বিভাগের অধ্যাপক হারিসুল হক, ক্যাম্পসের নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।