শহরের সুবিধা গ্রামে নিতে ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প, কী কী পাবে গ্রামের মানুষ

  • শহরের সুবিধা গ্রামে নিতে প্রাথমিকভাবে ১৫টি গ্রাম বেছে নেওয়া হয়েছে।

  • সরকারের এই মেয়াদে কাজ শুরু হওয়া নিয়ে সংশয়।

গ্রামের মাঠে কাজ করছে একদল কৃষক। মণ্ডলধরন গ্রাম, বগুড়া সদর
ফাইল ছবি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০১৮) আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের বিশেষ অঙ্গীকার ছিল ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’। সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অগ্রগতি খুব একটা ছিল না।

শহরের সুবিধা গ্রামে নিতে গত জুলাইয়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি পাইলট (পরীক্ষামূলক) প্রকল্প নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটির মাধ্যমে ১৫টি গ্রামে শহরের সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। তবে সরকারের চলতি মেয়াদে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারে বলা হয়, প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরের সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই অঙ্গীকারে দেশের গ্রামগুলোকে শহরে রূপান্তরের কথা বলা হয়নি। প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরের সুবিধা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে এই অঙ্গীকার করা হয়।

‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ ছিল সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। তবে ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে মেয়াদের শেষ দিকে।

গ্রামে শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই ‘আমার গ্রাম, আমার শহর: পাইলট গ্রাম উন্নয়ন’ নামের প্রকল্পটি নেওয়া হয়। গত ১৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি পাস করা হয়। ২০২৬ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা।

প্রকল্পটির অধীনে সড়ক, সেতু ও মাঠ তৈরি, গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি সরবরাহব্যবস্থা করা, হাটবাজার, কবরস্থান ও ঈদগাহের সংস্কার এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি উন্নয়ন করা হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।

সমীক্ষা-বাছাইয়ে কারিগরি প্রকল্প

স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২০ সালের শুরুতে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’–এর একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর আলোকে একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই কারিগরি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।

‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ ধারণাটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সরকারের ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জড়িত। অঙ্গীকারটি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।

কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের অধীনে দেশের ভৌগোলিক অঞ্চলনির্বিশেষে সব গ্রামে নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে আটটি ক্ষেত্রে ৩৬টি সমীক্ষা এবং ৩০টি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ১৫টি গ্রাম বেছে নেওয়া হয়।

যেসব গ্রামে যাবে নগরের সুবিধা

পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশের আট বিভাগের আটটি উপজেলার আটটি গ্রামকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া হাওর, চর, পার্বত্য জেলা, উপকূল, বরেন্দ্র, বিল এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলসংলগ্ন আরও সাতটি গ্রামকে বাছাই করা হয়েছে।

গ্রামগুলো হলো কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের শাকচাইল, খুলনার ডুমুরিয়ার টিপনা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দাতিনাখালি, সুনামগঞ্জের শিমুলবাঁক, নওগাঁর নিয়ামতপুরের খোরদো চম্পা, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের চরশরত, রাঙ্গামাটির বরকলের ছোট হরিণা, সিলেটের গোয়াইনঘাটের বাগাইয়া, রাজশাহী বাগমারার সোনাডাঙ্গা, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর পাথরডুবি, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, বরিশালের হিজলার ইন্দুরিয়া, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বিলচান্দা, নরসিংদীর মনোহরদীর হাফিজপুর এবং নেত্রকোনার বারহাট্টার দক্ষিণ ডেমুরা।

গ্রামে কী সুবিধা পাওয়া যাবে

প্রকল্প প্রস্তাব অনুসারে, প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৫৭ কিলোমিটার সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ। পরিচ্ছন্ন জ্বালানির জন্য ৫৩ হাজার ‘বন্ধু চুলা’ সরবরাহ করা হবে গ্রামবাসীকে। থাকবে বায়োগ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা এবং সড়কবাতি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করতে পাইলট গ্রামে ২৩টি গ্রামীণ হাটবাজার নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন ও পুকুর খননের কাজ করা হবে।

এ প্রকল্পে গ্রামীণ আবাসনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়াই ‘নিজেদের গ্রামে, নিজেদের জমিতে’ মডেলের মাধ্যমে আবাসন গড়ে তোলা হবে। প্রকল্প প্রস্তাবের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে তিনটি গ্রামে ৬৮টি চারতলা আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। জমি এবং ১০ শতাংশ অর্থ উপকারভোগী দেবেন। বাকি ৯০ শতাংশ অর্থ সুদমুক্ত কিস্তিতে ২৫ বছরে পরিশোধ করবেন। এ আবাসন সুবিধা তৈরি করতে ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হবে ৬২ কোটি টাকা। গ্রামের সড়কে বনায়নের জন্য রাখা হয়েছে ২ কোটি টাকা। প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ হাজার ১০০ বেকার তরুণকে জীবনমান উন্নয়নে পেশাভিত্তিক হস্তশিল্প ও কৃষি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ কোটি টাকা।

বিশুদ্ধ পানির জন্য পাইপে পানি সরবরাহ এবং নলকূপ (সাবমারসিবল টিউবওয়েল) স্থাপন করা হবে। পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনে ব্যয় হবে ৪৩ কোটি টাকা। প্রতিটি পাইলট গ্রাম ও তার বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে তোলা হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র।

‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী আবুল মনজুর মো. সাদেক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমীক্ষার মাধ্যমে নানা ধরনের সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। এক ভৌগোলিক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য ভৌগোলিক অঞ্চলের গ্রামীণ এলাকার চ্যালেঞ্জগুলোর মিল নেই। যেকোনো কাজে জমি অধিগ্রহণ একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি উদ্ভাবনী কৌশলও পরীক্ষামূলক প্রকল্পে নেওয়া হয়েছে।

‘কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিতে হবে’

একনেকে প্রকল্পটি পাস হলেও এর কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হতে সময় লাগবে। এখনো প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্পের অর্থ ছাড় হবে। ফলে আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির আগে প্রকল্পের কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

প্রকল্পটির বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, লোকজনের গ্রাম থেকে শহরে আসার বড় কারণ কাজের সন্ধান। গ্রামে কাজের সুযোগ সীমিত, বাড়তি আয়ের কারণে শহরে আসে। তাই গ্রাম উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে এটি সম্ভব হবে না, গ্রামে বিনিয়োগ নিয়ে যেতে হবে।