ভোটের আগে পুলিশের আরও অর্ধশতাধিক পদে রদবদল আসছে

জাতীয় নির্বাচনের আগে গত এক মাসে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ৬৯টি পদে রদবদল হয়েছে। শিগগিরই উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক, পুলিশ সুপারসহ আরও অর্ধশতাধিক পদে পদোন্নতি ও রদবদল করা হবে বলে জানা গেছে।

এই সময়ে পুলিশের এই রদবদল সরকারের নির্বাচনকালীন প্রস্তুতি হিসেবে আলোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, চাকরির মেয়াদ দুই বছরের বেশি হওয়া কর্মকর্তাদেরই বদলি করা হয়েছে।

রদবদলের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা বেশি। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়া কর্মকর্তাদের বড় অংশ ছাত্রজীবনে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন অথবা পরিবারের কেউ না কেউ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

সরকার তো চাইবেই নিজেদের লোকজনকে পুলিশ ও প্রশাসনে রাখতে। এখন নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করবে তারা সরকারদলীয় বা পক্ষপাতদুষ্ট লোকজনকে রাখবে কি, রাখবে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন

নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণে বদলি বা পদায়নের এই অভিযোগ মেনে নিতে রাজি নন সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু হলে নির্বাচন কমিশন বিভাগ, জেলা বা ইউনিটে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের এমনিতেই বদলি করত।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন চাইলেও এসব কর্মকর্তাকে সহজে সরাতে পারবে না। কারণ, তাঁরা দুই বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করার পর বদলি হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে আবার কর্মস্থল পরিবর্তন করার বিষয়টি যৌক্তিক হবে না।

আরও পড়ুন

এই বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার তো চাইবেই নিজেদের লোকজনকে পুলিশ ও প্রশাসনে রাখতে। এখন নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করবে তারা সরকারদলীয় বা পক্ষপাতদুষ্ট লোকজনকে রাখবে কি, রাখবে না।’

এমনও পুলিশ কর্মকর্তা আছেন, যাঁর কর্মস্থলে তিন বছর মেয়াদ পার হয়েছে। এমন কর্মকর্তাদের বদলি না করলেই বরং প্রশ্ন উঠত। তখন হয়তো বলা হতো, নির্বাচন প্রভাবিত করতে সরকার একই স্থানে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে রেখে গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

সরকারের বদলি নীতিমালা অনুযায়ী, একই পদে তিন বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেই মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও উহার অধীনস্থ দপ্তর/পরিদপ্তরসমূহের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নতুন পদে/স্থানে বদলি করতে হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে নানা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় প্রশাসক পদে বড় ধরনের রদবদল করা হয়েছে। সবশেষ ১৫ ও ১৬ জুলাই পুলিশে বড় ধরনের রদবদল করেছে সরকার। ওই দুই দিনে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) পদে ৪০ জনকে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ জুলাই এসপি পদের ২৪ জনকে বদলি করা হয়। তার আগের দিন বদলি করা হয় উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার ১৬ কর্মকর্তাকে। গত ১৩ জুন পুলিশ বাহিনীর ২৯ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে গত ১৩ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ডিআইজি ও এসপি পদমর্যাদার ৬৯ কর্মকর্তাকে রদবদল করা হয়।

আরও পড়ুন

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, সরকার নির্বাচন সামনে রেখে পছন্দমতো মাঠ প্রশাসন সাজাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এসব রদবদল করা হচ্ছে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আবদুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের রদবদলের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ছক করছে। নির্বাচনী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশ্বস্ত লোকদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হচ্ছে।

এদিকে গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন পদোন্নতিবঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তা। তাঁরা প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে সমন্বয় চেয়ে পদোন্নতির দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্ম সচিব হয়ে গেছেন, কিন্তু পুলিশের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিত। সে জন্য তাঁদের দাবি, তাঁরা যেন একই মর্যাদা পান। তাঁদের দাবি প্রস্তাব আকারে দেওয়া হবে।

দুই দিনে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) পদে ৪০ জনকে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ জুলাই এসপি পদের ২৪ জনকে বদলি করা হয়। তার আগের দিন বদলি করা হয় উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার ১৬ কর্মকর্তাকে।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশের পদোন্নতির সমন্বয় হওয়াটা খুবই জরুরি। কারণ, একই পদমর্যাদার প্রায় একই সময়ে যোগদান করার পরও তাঁরা সমপদমর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

২৮ বিসিএসের একজন অতিরিক্ত কমিশনার জানান, তাঁদের মধ্যে ২৫ জনকে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি দেওয়া হলেও ১৩ বছর দায়িত্ব পালনের পরও ১৫৫ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

একইভাবে একজন উপকমিশনার বলেন, ২৪তম বিসিএস ব্যাচের মাত্র ছয়জন অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, যদিও তাঁদের ব্যাচের ১৬৫ জন এই পদের জন্য যোগ্য ছিলেন।

আওয়ামী লীগ বিশেষ করে গত দুটি (২০১৪ ও ২০১৮) নির্বাচনের আগে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ ও প্রশাসনে পদোন্নতি দিয়েছে ও রদবদল করেছে। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসেও একইভাবে পুলিশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করা হয়। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে ৬১৭ জন পুলিশকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। একইভাবে ২০১৮ সালের নভেম্বরে অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদে পদোন্নতিসহ প্রায় ৩০০ কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে এত কর্মকর্তার পদোন্নতির বিষয়টিকে বাহিনীর সদস্যরা ‘রাজনৈতিক পদোন্নতি’ হিসেবে দেখছেন।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দাবি, এসব বদলির সঙ্গে নির্বাচন বা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশের পদোন্নতি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমনও পুলিশ কর্মকর্তা আছেন, যাঁর কর্মস্থলে তিন বছর মেয়াদ পার হয়েছে। এমন কর্মকর্তাদের বদলি না করলেই বরং প্রশ্ন উঠত। তখন হয়তো বলা হতো, নির্বাচন প্রভাবিত করতে সরকার একই স্থানে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে রেখে গেছে। আবার যাঁদের দুই বছরের অধিক, তাঁদেরও সরানো হচ্ছে। এখন যেহেতু নির্বাচন সামনে, সেহেতু সবাই মনে করছে এটা নির্বাচনকেন্দ্রিক।