গভীর বেদনা নিয়ে ঈদ কাটাবেন তাঁরা
গলির মুখে দেয়ালে লাল রঙের নির্দেশক প্রতীক সাঁটানো। তাতে হলুদ রঙের হরফে লেখা ‘শহীদ আহনাফ সড়ক’। এর নিচে একটি ছোট সাইনবোর্ডে লেখা, ‘আহনাফ কবির মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’। রাজধানীর কল্যাণপুরের মধ্য পাইকপাড়া এলাকায় গলিটিতে দাঁড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘ওটাই আফনাফদের বাসা।’ বুধবার সকালে ছয়তলা বাড়ির ছাদঘেঁষা ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়তেই খুলে দিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের মা। মিরপুর ১০ নম্বরে আন্দোলনে থাকার সময় ৪ আগস্ট গুলিতে শহীদ হয় আহনাফ (১৭)। তার বাম বুকে গুলি লেগে ডান বুক থেকে বের হয়ে গিয়েছিল।
সাত বছর আগে দুই কক্ষের বাসাটায় ভাড়া এসেছিলেন নাসির উদ্দিন আহমেদ ও জারতাজ পারভীন দম্পতি। তাঁদের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছিল আহনাফ। ১০ মাস হয়ে গেছে, ছেলে নেই। তবে ঘরজুড়েই তার ‘তীব্র উপস্থিতি’।
আহনাফের মৃত্যুর পর প্রথমবার ঈদুল আজহা আসছে। মাত্র ১০ মাস আগে সন্তান হারানো কোনো পরিবারে ঈদ কেমন যায়, সেই প্রশ্ন করতে মনে নানা দ্বিধা এসে ভর করে। তবে আহনাফের মতো শহীদ নাঈমা সুলতানা ও গোলাম নাফিজের পরিবার জানাল, অনেক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঈদুল ফিতর গেছে। ঈদুল আজহাও তাঁরা কাটাবেন স্মৃতি হাতড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক ঈদে ওরা ছিল, সেই স্মৃতি তাঁদের বেদনা বাড়ায়।
ওর কোনো চাহিদা ছিল না। কখনো ঈদেও কিছু চাইত না। মা–বাবার কষ্ট বুঝত। দেখুন, কত কম কাপড়চোপড় ওরআহনাফের মা
‘আমাদের জীবনে আর ঈদ আসবে না’
ঈদুল ফিতরের মতো এই ঈদেও তাঁদের কোনো প্রস্তুতি নেই বলে জানালেন আহনাফের মা জারতাজ। ধরা গলায় বললেন, ‘আমাদের জীবনে আর কখনো ঈদ আসবে না। ও পোলাও-রোস্ট পছন্দ করত। এখন আর এসব রান্না করতেও ইচ্ছা করে না।’
কথা বলতে বলতে মা আলমারির দরজার একটা পাল্লা খুলে বললেন, ‘ওর কোনো চাহিদা ছিল না। কখনো ঈদেও কিছু চাইত না। মা–বাবার কষ্ট বুঝত। দেখুন, কত কম কাপড়চোপড় ওর!’ আলমারির পাল্লায় আহনাফের তিন ধরনের বয়সের ছবি লাগানো। সেটা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা ওর ছয় মাস বয়সের। এটা দুই বছর বয়সের। আমরা ট্রেনে করে সিলেট যাচ্ছিলাম। আর এটা ও চলে যাওয়ার দুই মাস আগের ছবি। ফুটবল খেলে ওদের ক্লাব ট্রফি জিতেছিল। ও ফুটবলপাগল ছিল।’ গিটার বের করে দেখিয়ে বললেন, ‘ও গানও খুব পছন্দ করত!’
মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাদির কবরে আহনাফ শায়িত। বাবা ও ভাই প্রতি শুক্রবার কবর জিয়ারত করেন। ঈদের দিনও যাবেন। ঈদের পর তাঁরা আহনাফের নামে স্থানীয় এতিমখানায় ১৫০ জন শিশুকে খাওয়াবেন।
‘ঈদ নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস ছিল নাঈমার’
‘শ্বশুরবাড়িতে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। ঈদ সবাই একসঙ্গে করে। ঈদ নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস ছিল নাঈমার। জামার সঙ্গে দুল, লিপস্টিক মিলিয়ে কিনত। ওর পছন্দে ওর বড় বোনও কেনাকাটা করত।’—মুঠোফোনে কথাগুলো বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন জুলাই শহীদ নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে নাই। আমার ঈদও নাই, কিছু নাই।’ জীবন থেমে থাকে না, তাই নিজেকে ঠেলেঠুলে চালান। তিনি বললেন, ‘মেয়েটাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নাই। সাইকোলজিস্ট (মনোবিজ্ঞানী) দেখাই। কত কত ওষুধ খাই! তা–ও সুস্থ থাকি না। আমার হাতের ওপর মেয়ের রক্তে ভেসে যাওয়া দেহ, কীভাবে ভুলি!’
গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে উত্তরার বাসার বারান্দায় (৫ তলা ভবনের ৪ তলায়) শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় নাঈমা। ওই দিনের মাত্র ৫ দিন পর তার বয়স হতো ১৫ বছর। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল দ্বিতীয়। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ত। মা জানান, ওই বাসাতেই দুই সন্তান নিয়ে তিনি এখন থাকছেন। নাঈমার বাবা গ্রামে থাকেন। সন্তানদের ভালো পড়াশোনা করানোর জন্য তিনি ঢাকায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
মেয়েটাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নাই। সাইকোলজিস্ট (মনোবিজ্ঞানী) দেখাই। কত কত ওষুধ খাই! তা–ও সুস্থ থাকি না। আমার হাতের ওপর মেয়ের রক্তে ভেসে যাওয়া দেহ, কীভাবে ভুলি!শহীদ নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার
ঈদেও পতাকা ওড়াত নাফিজ
কপালে পতাকা বাঁধা ছেলেটির চোখ দুটো বন্ধ, শরীর রিকশার পাদানিতে, পা দুটো রাস্তা ছুঁইছুঁই, এক হাত আলতোভাবে রিকশার রড ধরা। একজন রিকশাচালক প্যাডেল ঘুরিয়ে ছেলেটিকে টেনে নিচ্ছেন। ছবির ছেলেটি জুলাই শহীদ গোলাম নাফিজের (১৭)। মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা এই ছবিটা সবার চেনা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাড়া জাগানো ছবির একটি এটি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের কাভার ফটো হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ছবিটি।
রাজধানীর মহাখালীর বাসিন্দা গোলাম রহমান ও নাজমা আক্তারের দুই ছেলের মধ্যে নাফিজ ছিল ছোট। সে নৌবাহিনী কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। ৪ আগস্ট ফার্মগেটে আন্দোলনে থাকার সময় গুলি নাফিজের বুকে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বুধবার সকাল পৌনে ৯টায় নাফিজদের মহাখালীর বাসার কাছে গিয়েও ফেরত আসতে হয়। ছেলের কবর জিয়ারত করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মা–বাবা। দাদাবাড়ি উত্তরখানে দাদার কবরের পাশে সমাহিত নাফিজ। গোলাম রহমান মুঠোফোনে বলেন, ছোটবেলা থেকে গরু কিনতে হাটে যেত নাফিজ। এরপর পতাকা ওড়াত। দাদাবাড়িতে ঈদ করত পরিবারের সবার সঙ্গে।