জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিছক একটি রাজনৈতিক পালাবদল নয়, বরং তা বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানে সম্ভাব্য পুনর্গঠনের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। রাজপথে নেমে আসা নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও বৈষম্যহীনতার দাবি—যা কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই নয়, বরং দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকেও নতুন করে চিন্তার মুখে ফেলেছে। এ প্রজন্ম আর বলয়–নির্ভরতা চায় না। তারা চায় নীতিনিষ্ঠ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও সমতাভিত্তিক এক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে আমরা দেখছি, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান এখন দ্বিধা, অস্পষ্টতা ও সমন্বয়হীনতার এক সংকটময় ধাঁধায় আটকে পড়েছে।
বাংলাদেশ অতীতে দুই প্রতিবেশী, ভারত ও পাকিস্তান নিয়ে একধরনের দোদুল্যমান নীতি অনুসরণ করেছে। কখনো ভারতনির্ভর, কখনো পাকিস্তানপন্থী অবস্থান—এই দোলাচল রাজনৈতিক শিবিরভেদে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে আজকের প্রজন্ম এমন এক বাংলাদেশ চায়, যার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হবে কোনো বলয়-নির্ভরতার ভিত্তিতে নয়, বরং নীতিগত অবস্থান, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থকে ভিত্তি করে।
এই পরিবর্তিত প্রজন্মের দাবি ও বলয়নিরপেক্ষ নীতির প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া এবং এ–সংলগ্ন অঞ্চলে দ্রুত রূপান্তরশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায়। মিয়ানমারে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও সেনা-জাতিগত দ্বন্দ্ব, রোহিঙ্গা–সংকট, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা এবং বঙ্গোপসাগর ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি এখন অস্থির হয়ে আছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান, সিদ্ধান্ত ও কূটনৈতিক কৌশল কতখানি সুসংগঠিত, আত্মনির্ভর ও পেশাগত যোগ্যতাসম্পন্ন, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যুক্ত হয়, আর ২০২৩ সালে ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। ফলে একধরনের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির রূপরেখা দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ভারসাম্য কৌশল কি আদৌ সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত ছিল, নাকি তা সীমিত ছিল কেবল চমকপ্রদ ঘোষণার মধ্যেই?
অনেকে মনে করছেন, বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিতে সমন্বয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশাদারত্বের অভাব প্রকট। সরকারের উঁচু পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবায়নের পর্যায়ে তা মোটাদাগে অনুপস্থিত বলেই মনে হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান যেন অনেকটাই প্রান্তিক। ভূরাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রায়ই এলোমেলো ও পরস্পরবিরোধী বলে মনে হচ্ছে। যেমন মিয়ানমারের আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ প্রশ্নে সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ও অস্পষ্ট বার্তা এসেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মতো সংকটকে তা জটিলতর করে তুলেছে।
এই নীতিগত দ্বিধা আংশিকভাবে ক্ষমতার রাজনৈতিক বৈধতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অনেকের ধারণা। তবে কোনো সরকার যদি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত না হয় কিংবা তার রাজনৈতিক সমর্থনের ঘাটতিও থাকে, তবু জনসমর্থনপুষ্ট হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবস্থান শক্তিশালী করে তোলা যায়। তার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী ও সুসংগঠিত কূটনীতি। কূটনীতি এমন এক জটিল ক্ষেত্র—যেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারি কাঠামো, সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উদাহরণস্বরূপ, রোহিঙ্গা সংকট ও সামগ্রিকভাবে আরাকান পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের সফলতা দাবি করার সুযোগ খুব একটা নেই। বরং সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আসা বিবৃতি ও পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের মনে বহু প্রশ্ন ও সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও হয়েছে অধিকতর জটিল। এ অবস্থান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সেটি বাস্তবতা, কৌশল ও সম্ভাব্য পরিণতি বিবেচনায় নিয়েই নির্ধারণ করতে হবে। আবেগ বা চমক দিয়ে কূটনীতি চলে না। ইচ্ছা করলেই সবকিছু হয় না; আবার সঠিক কৌশল ও কাঠামো থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশের প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত কূটনৈতিক কাঠামো, যেখানে আরাকান অঞ্চলের বাস্তবতা বোঝা এবং কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি সব পক্ষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় মাত্রায় যোগাযোগের ভিত্তি থাকবে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার, আরাকান আর্মি, স্থানীয় গোষ্ঠী—প্রত্যেকের সঙ্গে পর্যাপ্ত ও সংবেদনশীল সংলাপ প্রয়োজন। কোথাও সরকারিভাবে, কোথাও বেসরকারি পর্যায়ে, আবার কোথাও কৌশলগত বা টেকনিক্যাল পর্যায়েও সংযোগ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতিতে নীতিগত সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় অপরিহার্য।
দুঃখজনকভাবে এই কাঙ্ক্ষিত সমন্বয় এখনো আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে দৃশ্যমান নয়। আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যদি মিয়ানমার সরকার প্রশ্ন তোলে, কিংবা ভবিষ্যতে যদি তারাই আরাকান আর্মির সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছায়, তখন বাংলাদেশ কী অবস্থান নেবে? এসব প্রশ্ন আমাদের কৌশলগত প্রস্তুতির ঘাটতির দিকেই ইঙ্গিত করে।
আমার দৃষ্টিতে প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়তা করা, যেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্থিতিশীল প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি হয়। এই লক্ষ্য অর্জনে চীন বা অন্য কোনো আঞ্চলিক শক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করা হোক বা সরাসরি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে গঠনমূলক ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রাখা হোক—সব ক্ষেত্রেই একটি বাস্তবসম্মত, মানবিক ও সমন্বিত কৌশল নেওয়া অপরিহার্য।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের কূটনীতির সামনে অন্তত চারটি বড় ও সুস্পষ্ট চ্যালেঞ্জ আছে: ১. বহির্বিশ্বের সঙ্গে সুষমভাবে কাজ করে সুশাসনের মাধ্যমে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্যে কর্মসংস্থানসহ তাদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সহায়ক অভ্যন্তরীণ পরিবেশ তৈরি; ২. রোহিঙ্গা সংকট ও মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা; ৩. বঙ্গোপসাগর ঘিরে শক্তি নিরাপত্তা ও ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতা; ৪. যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত বলয়ের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ ও আত্মনির্ভর কূটনৈতিক অবস্থান প্রতিষ্ঠা।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কূটনীতিকে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট), কূটনীতি (ডিপ্লোমেসি) ও প্রতিরক্ষা (ডিফেন্স)—এই ‘থ্রি-ডি’ কাঠামোর মধ্যে সত্বর সমন্বয় আনতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশ্বের জানালা হিসেবে পুনর্গঠন করে তা পেশাদারি দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সমর্থনের মাধ্যমে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলগতভাবে বাইরের শক্তির ওপর ভর করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কখনো আমলাতন্ত্রের আশ্রয়, কখনো সামরিক সমর্থন, কখনো আবার আঞ্চলিক শক্তির সহযোগিতা—এসব একটি স্বাধীন, নীতিনির্ভর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববাস্তবতা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন এমন এক পররাষ্ট্রনীতি, যার ভিত্তিতে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা পাকিস্তান—প্রতিটি দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক পুনর্বিন্যস্ত হবে সমতা, স্বার্থ ও মর্যাদার ভিত্তিতে। ইতিহাস, আবেগ বা শিবিরভেদ নয়, বরং জাতীয় প্রয়োজন ও জনগণের কল্যাণই হোক আমাদের কূটনৈতিক অবস্থানের মূল দিকনির্দেশনা।
আমাদের বুঝতে হবে, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগের প্রধান মাধ্যম হলো কূটনীতি। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু অর্থায়ন, নিরাপত্তা সহযোগিতা—সব কূটনীতির ছায়াতলে পরিচালিত হয়। সুতরাং আমরা যদি চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করি কিংবা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখি—তা হতে হবে জাতীয় স্বার্থ, বাস্তব প্রয়োজন ও তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা সামনে রেখে। কেবল তখনই বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে।
অনুলিখন: সৈয়দ রিফাত মোসলেম
এম হুমায়ুন কবির: সভাপতি, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই); সাবেক রাষ্ট্রদূত