স্মরণসভায় বক্তারা
ক্ষুদ্র প্রাণ, সামান্য বস্তুও যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা তুলে ধরতেন রেজাউর রহমান
নব্বইয়ের দশকে বহির্বিশ্বের প্রাণ নিয়ে লেখক ও বিজ্ঞানী রেজাউর রহমানের আলোচনা ছিল বিস্ময়কর। ক্ষুদ্র প্রাণ, সামান্য বস্তুও যে প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ, সেই পাঠ তিনি তুলে ধরতেন। সদ্য প্রয়াত ড. রেজাউর রহমান ছিলেন জীবনকে সহজ করে বোঝার স্কুল। স্মরণসভায় এসব কথা বললেন গুণীজনেরা।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় রেজাউর রহমান স্মরণসভা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে স্যারের (রেজাউর রহমান) বক্তৃতা শুনতে যেতাম অ্যাটোমিক এনার্জিতে। সেই সময়ে বহির্বিশ্বের প্রাণ ছিল তাঁর আলোচনার প্রিয় বিষয়। তিনি কঠিন প্রসঙ্গ নিয়ে ছোট ছোট বাক্যে সহজ ভাষায় কথা বলতেন।’ লেখক ও সাংবাদিক খান রবিউল আলমের বক্তব্যে উঠে আসে পরম্পরার দায়বদ্ধতা থেকে রেজাউর রহমানের কাজ নিয়ে চর্চার আহ্বান। তিনি উল্লেখ করেন, প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের সামষ্টিক রূপের গুরুত্ব তুলে ধরতেন রেজাউর রহমান।
রেজাউর রহমানের দুই মেয়ে দেশের বাইরে শিক্ষকতা করছেন। তাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন বাবার স্মরণসভায়। মঞ্জুলিকা রহমান বাবাকে নিয়ে স্মৃতিকথায় তাঁদের বাড়ির সামনের কদমগাছটির সুষ্ঠু বিন্যাসে বেড়ে ওঠা তাঁর বাবার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে কথা উল্লেখ করেন।
আরেক মেয়ে নীলাঞ্জনা রহমান বললেন, ‘অন্য মানুষের চোখে আমাদের বাবা কেমন, তা বুঝতে পারলাম এই আয়োজনে এসে।’
বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরীর বক্তব্যে উঠে আসে রাজনৈতিকভাবে ভীষণ সচেতন থাকলেও নিজের লেখা নিয়ে রেজাউর রহমানের গোপনীয়তা বজায় রাখার অভ্যাসের কথা।
রেজাউর রহমানের সবচেয়ে ছোট ভাই চিকিৎসক জাকিউর রহমান তাঁর ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করেন তাঁদের শৈশবে দেখা বংশাল, গ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এনে। বললেন, সেই সময়ে বাড়িতে ল্যান্ডফোন আসার সূত্র ধরে সহোদর রেজাউর রহমানের সঙ্গে নিজের অম্লমধুর স্মৃতিকথা। তবে রেজাউর রহমানের প্রতি পরিবারের নির্ভরশীলতার কথা জানা গেল তাঁর আরেক ভাই প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের স্মৃতিচারণায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের আরও নয়জন সদস্যকে নিয়ে রেজাউর রহমান যেভাবে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বন্ধুর পথ ভেঙে ভেঙে গ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন, তা ছিল রোহমহর্ষক। মতিউর রহমান বলেন, পরিবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই সেই সময় নির্ভরশীলতা ছিল তাঁদের মেজ ভাই রেজাউর রহমানের ওপর।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ছোট বস্তু বা প্রাণেরও যে নিজস্ব মূল্য আছে, সেটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন রেজাউর রহমান। বিজ্ঞানী, লেখকের চেয়েও বড় মানুষ ছিলেন তিনি।
লেখক মোরশেদ শফিউল হাসান আলোচনা করেন রেজাউর রহমানের সাপ বইটির পাঠ অভিজ্ঞতা নিয়ে। সদ্য প্রয়াত এই বিজ্ঞানী যে ব্যক্তিজীবনেও কতখানি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন, সে উদাহরণ পাওয়া যায় বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের কথায়। তিনি বলেন, যানজটের সময়টুকুকে ব্যবহার করতে রেজাউর রহমান চোখের সামনে থাকা গাড়ির নম্বরগুলো নিয়েও অঙ্ক করতেন।
রেজাউর রহমানের শেষ সময়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেন তাঁর পরিবার ঘনিষ্ঠ একরামুল হক। আরও বক্তব্য দেন আহছান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক গোলাম মোস্তফাসহ অন্যান্যরা।
রেজাউর রহমান স্মরণানুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌফিক। আয়োজনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসার। অনুষ্ঠান শুরু হয় বিজ্ঞানী ও লেখক রেজাউর রহমানকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। সদ্য প্রয়াত এই গুণীজনের স্মরণে রবীন্দ্রসংগীত গান প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।
ব্যক্তিগত জীবনে বিনয়ী ও সদাচারী রেজাউর রহমান প্রাগ থেকে কীটতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে কাজ করেন তিনি। কীটপতঙ্গ নিয়ে দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে তাঁর। পেশাগতভাবে বিজ্ঞানী হলেও লেখক হিসেবে রেজাউর রহমানের বিশেষ খ্যাতি ছিল। বিজ্ঞানে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি। গত ২৬ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন রেজাউর রহমান।