ঘরে বসে মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানছেন বিচারপ্রার্থীরা

আদালত
প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রামের পটিয়ার দিনমজুর আবদুল হালিমের বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রী আড়াই বছর আগে যৌতুকের মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ চট্টগ্রামে।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে, বিশেষ করে পরবর্তী তারিখ জানার জন্য তাঁকে পটিয়া থেকে চট্টগ্রামে আসতে হতো। আইনজীবীর সহকারীর মাধ্যমে তারিখ জানতে গুনতে হতো ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। গত ২৮ আগস্ট ধার্য দিনে আবদুল হালিম আদালতে হাজির ছিলেন। পরদিন সকালে তাঁর এক বন্ধুর মুঠোফোনে মামলার কার্যতালিকা সার্চ দিয়ে জেনে যান, মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ৯ নভেম্বর।

এতে অনেক খুশি আবদুল হালিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে মামলার পরবর্তী তারিখ জানতে টাকা খরচের পাশাপাশি তিন থেকে চার দিন সময় লেগে যেত। এখন এক দিন পরেই জেনে যান।
শুধু আবদুল হালিমই নন, চট্টগ্রাম আদালতের বিচারপ্রার্থীরা ঘরে বসেই জেনে যাচ্ছেন মামলার সর্বশেষ অবস্থা। এক সপ্তাহ আগে এটি চালু হয়েছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। নষ্ট হচ্ছে না কর্মঘণ্টা।

সরকারের অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের সহযোগিতায় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অর্থায়নে ২০২২ সালের জুন মাস থেকে সাতটি জেলায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোয় অনলাইন কজলিস্ট বা ই-কার্যতালিকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর একজন করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে ঢাকায় বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ওই প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর থেকে প্রথমভাগেই সাত জেলার ই-কার্যতালিকা চালু করা হয়। পরে সারা দেশে পর্যায়ক্রমে এই কার্যক্রম শুরু করে।

এক সপ্তাহ আগে থেকে চট্টগ্রাম আদালতের বিচারাধীন মামলার তথ্য বিচারপ্রার্থীরা জানতে পারছেন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করে। এদিকে এক সপ্তাহ আগে এটি চালু হলেও বেশির ভাগ বিচারপ্রার্থী জানেন না। সবাই যাতে জানতে পারেন, সে জন্য আরও প্রচার-প্রচারণা চালানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ ক্ষেত্রে আইনজীবী, তাঁদের সহকারী ও আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভূমিকা রাখতে পারেন।

চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি মোড় এলাকায় চট্টগ্রাম আদালত ভবন অবস্থিত। এখানে ৭৬টি আদালত রয়েছে। আর এসব আদালতে বিচারাধীন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩০০টি মামলা। প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের বেশি বিচারপ্রার্থী আদালতে আসেন। মিরসরাই, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজানসহ নগর ও জেলার দূরদূরান্ত থেকে ধার্য দিনে হাজিরা দিতে আসেন মামলার আসামিরা। আসেন বাদীরাও। ধার্য দিনে সাক্ষ্য দিতে আসেন সাক্ষীরা।

মামলার বাদী ও আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব আসামি কারাগারে আটক, তাঁদের মামলার ধার্য দিনে হাজির করতে আদালত থেকে কারাগারে পিডব্লিউ (প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট) পাঠানো হয়। আর যেসব আসামি জামিনে, তাঁদের মামলার পরবর্তী ধার্য দিনে হাজির থাকতে সংশ্লিষ্ট আদালতে থাকা মামলার কার্যতালিকায় লেখা থাকে। মামলার নম্বর দিয়ে যেকোনো একটি ধার্য দিন দেখে মামলার পরবর্তী তারিখ বের করতে হয়। ঝামেলার কারণে বিচারপ্রার্থীরা আইনজীবীর সহকারীর (মুনশি) মাধ্যমের এটি জেনে নেন। জানার জন্য তাঁরা অনেকে আদালতে ছুটে আসেন। তার জন্য গুনতে হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

পটিয়া উপজেলার দিনমজুর আবদুল হালিম আড়াই বছর ধরে তাঁর স্ত্রীর করা মামলায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (লিগ্যাল এইড) চট্টগ্রামের কর্মকর্তা এরশাদুল ইসলাম তাঁকে মুঠোফোনে মামলার তারিখ জানার বিষয়টি প্রথমে বলেন। এখন তাঁর ঝামেলা অনেক কমে গেছে। মামলার তারিখ জেনে যাওয়ায় পরবর্তী তারিখের জন্য প্রস্তুতি নিতেও সুবিধা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এক সপ্তাহ আগ থেকে চট্টগ্রামের বিচারপ্রার্থীরা ঘরে বসে তাঁদের মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে পারছেন মুঠোফোনে। আগে মামলার তারিখ জানতে কয়েক দিন সময় লেগে যেত। এখন বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ অনেক কমছে।

এদিকে বিচারপ্রার্থীদের অনেকেই নতুন এই সুবিধা সম্পর্কে জানেন না। গত ৩০ ও ৩১ আগস্ট সরেজমিন চট্টগ্রাম আদালতে দেখা যায়, বিচারপ্রার্থীরা পরবর্তী তারিখ জানার জন্য আইনজীবীর সহকারী কিংবা আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আদালত ভবনের তৃতীয় তলার বারান্দায় দেখা হয় নগরের আকবর শাহ এলাকা থেকে আসা মো. ইউসুফে সঙ্গে। বলেন, তিনি একটি মাদক মামলার আসামি। এখন জামিনে আছেন। মামলার পরবর্তী ধার্য তারিখ জানতে এসেছেন। এ জন্য আইনজীবীর সহকারীকে দিয়েছেন ২৫০ টাকা। আবার কখনো সরাসরি আদালতের কর্মচারীর মাধ্যমেও তারিখ জেনে নেন। মুঠোফোনে মামলার তারিখ দেখার বিষয়টি তিনি জানেন না। তাঁকে কেউ জানায়নি।

তবে কয়েকটি আদালতের বারান্দায় বিচারপ্রার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নোটিশ টাঙানো দেখা গেছে। এতে বলা হয়, ‘আমার আদালত’ (মাই কোর্ট) অ্যাপস ব্যবহার করে এই আদালতের বিচারিক কার্যক্রম জানতে পারবেন। নোটিশে অ্যাপসটি ব্যবহারের নিয়মও লেখা রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-সহ কয়েকটি আদালতের সামনে এমন নোটিশ দেখা গেলেও বেশির ভাগ আদালতের বারান্দায় এ রকম প্রচারণা দেখা যায়নি।

যেভাবে জানা যাবে কার্যতালিকা

যেকোনো স্মার্টফোন থেকে গুগলে মামলার কার্যতালিকা লিখে সার্চ দিলে ই-কার্যতালিকা আসবে।

সেখানে গিয়ে প্রথমে বিভাগ নির্বাচন করতে হবে। তারপর জেলা, অধস্তন আদালত ও তারিখ নির্বাচন করতে হবে। মামলার নম্বরের পাশে পরবর্তী তারিখ লেখা থাকবে। পাশাপাশি সাক্ষী, অভিযোগ গঠন, যুক্তিতর্কের বিষয়েও লেখা থাকে।

গুগলে সার্চ দেওয়া ছাড়াও স্মার্টফোনে ‘আমার আদালত’ অ্যাপ থেকেই প্রথমে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, পরে জেলা এবং সর্বশেষ সংশ্লিষ্ট আদালতের নাম নির্বাচন করে বিচারপ্রার্থীরা তাঁদের মামলার সর্বশেষ আদেশ, পরবর্তী তারিখ এবং মামলার অবস্থা জানতে পারবেন। গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘আমার আদালত’ সার্চ করে যে কেউ এ অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারবেন।