দ্বীপটিকে রক্ষা করতে হবে

অধ্যাপক আইনুন নিশাত

মানুষের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি পরিবেশ, প্রকৃতি, বন ও জলাভূমি রক্ষা করাও আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। দেশের সংবিধানে ২০১১ সালে এই ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সৈকত দিয়ে চলাচল করে যানবাহন। এসব যানবাহনের চাকার নিচে পড়ে মারা যায় কাঁকড়া
ছবি: জুয়েল শীল

কক্সবাজার উপকূলের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ এবং অনন্য জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। সরকারের একটি অংশ হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক।

কিন্তু এর সঙ্গে হতাশার দিক হলো, সরকারের বাকি অংশ অর্থাৎ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দ্বীপটি রক্ষায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে দেখছি না। বরং উল্টোভাবে বলা যায়, অনেকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে দ্বীপটি ধ্বংসের যে আয়োজন চলছে, তাতে সহায়ক ভূমিকা রাখছেন।

সেন্ট মার্টিনকে অনেকে প্রবাল দ্বীপ বলে থাকেন, কিন্তু এটি আসলে পাথুরে দ্বীপ। এর ওপর প্রবালের স্তর রয়েছে। এর পশ্চিম দিকে আরেকটি দ্বীপ জেগে উঠছে (এখনো নামকরণ হয়নি) যেখানে বিপুল পরিমাণ কড়ি নামক সামুদ্রিক শামুক পাওয়া যায়। নানা রঙের ওই কড়ি একসময় বাংলা অঞ্চলে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ছেঁড়া দ্বীপে সামুদ্রিক ঘোড়া নামে একধরনের মাছ এখনো মাঝেমধ্যে দেখা যায়। অনেক ধরনের দুর্লভ রঙিন মাছ এখানকার কোরালের কারণে বিচরণ করে থাকে। পৃথিবীর অন্যতম দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির জলপাই রঙের কাছিম বা অলিভ গ্রিন টার্টেল এখানে ডিম পাড়ে। এখানকার কেয়াবনসহ উদ্ভিদ ও প্রাণী শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।

আমি কোনোভাবেই পর্যটন বা প্রকৃতিনির্ভর বিনোদনের বিরোধী নই। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের একটি দ্বীপে কোনোভাবেই দিনে ৯০০ জনের বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া উচিত নয়, তাও সীমিত পরিসরে এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে তাদের যাতায়াত করতে দেওয়া উচিত। রাতে সেখানে কোনোভাবেই পর্যটকদের থাকতে দেওয়া উচিত নয়।

মেরিন পার্ক পূর্ব সমুদ্রসৈকত এলাকা
ছবি: জুয়েল শীল

সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও এ ব্যাপারে বারবার নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি, সরকারের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) বিধিমালা ভঙ্গ করে সেখানে আড়াই শর মতো হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এর মালিকদের মধ্যে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা রয়েছেন। যাঁদের ওই দ্বীপ রক্ষায় কাজ করার কথা, তাঁরা এই কারণে সেখানে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আইন করেছিলেন। জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সরকারের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই সরকারের উচিত ছিল কঠোরভাবে দ্বীপটি রক্ষায় ব্যবস্থা নিয়ে আইন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের প্রতি সম্মান দেখানো। দরকার হলে শক্তি প্রয়োগ করে দ্বীপটির প্রকৃতি ধ্বংস করে গড়ে ওঠা অবকাঠামো উচ্ছেদ করতে হবে, দ্বীপটিকে রক্ষা করতে হবে।

দ্বীপটিতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ বসবাস করে। তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। আমরা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছি। তাহলে সেন্ট মার্টিন রক্ষায় কেন পাঁচ হাজার স্থানীয় মানুষকে অন্যত্র জায়গা দিতে পারব না? এতে দ্বীপটিকে মানুষের বসবাসের মাধ্যমে যে বিপদ তৈরি হচ্ছে, তা থেকে রক্ষা করা যাবে।

  • আইনুন নিশাত, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়