ইভিএমে কারচুপি হলে কেউ যাচাই করতে পারবে না: সুজন

বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আজ ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের উপযোগিতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছবি: খালেদ সরকার

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও ভোটের ফলাফল তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন এবং অস্বচ্ছতার সুযোগ রয়েছে—এমনটাই মনে করে বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। এর কারণ হিসেবে সুজন বলছে, ভোট গণনার পর যে কার্ডের (অডিট কার্ড) মাধ্যমে এটি সংগ্রহ করা হয়, সেই কার্ড পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব।

‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের উপযোগিতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সুজনের পক্ষ থেকে এমন মতামত তুলে ধরা হয়। সুজনের পক্ষে ইভিএমের কারিগরি দিক পর্যালোচনা ও নির্বাচনে এর প্রভাব শীর্ষক উপস্থাপনাটি তুলে ধরেন প্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। আজ রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সুজন।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ভোট গ্রহণের পর ফলাফল সংগ্রহ করতে কেউ যদি বিকল্প কার্ড নিয়ে আসেন এবং সে কার্ডে পছন্দের ফলাফল ঠিক করে রাখেন, তাহলে ফলাফল জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণ করে দেখানো যাবে না। প্রমাণ করতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের কাছে আড়াই লাখ অডিট কার্ড আছে। এসব কার্ড দিয়ে অন্তত ৭০টি আসনে নির্বাচন করা যাবে। কমিশন যদি আরও আড়াই লাখ কার্ড কেনে, তাহলে মোট পাঁচ লাখ কার্ডের ‘ফরেনসিক’ সম্পন্ন করার সক্ষমতা দেশের কোনো রাজনৈতিক দলেরও নেই। কারণ, এটা কয়েক মাসের কাজ। এ কাজে কয়েক হাজার প্রকৌশলীর প্রয়োজন।

ইভিএমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল হলেও বুথ থেকে ফলাফল হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ‘ম্যানুয়াল’ বলে উল্লেখ করেন ফয়েজ আহমদ। তিনি বলেন, ফলাফল তৈরির প্রক্রিয়া ওই কার্ডের ওপর নির্ভর করে। যদি কেউ ওই কার্ডে জালিয়াতি করেন, তাহলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও এটা যাচাই করা সম্ভব নয়। কোনো রাজনৈতিক দল বা গণমাধ্যমকর্মীর পক্ষেও যাচাই করা সম্ভব নয়। এর ফলে এটি একটি বড় ঝুঁকির জায়গা।

প্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, যদিও ব্যবস্থাটা ডিজিটাল, এরপরও বাংলাদেশের ভোট ব্যবস্থায়, ভোট গণনায় যথেষ্ট অস্বচ্ছতার সুযোগ রয়ে গেছে। এ বিষয়টা যত দিন পর্যন্ত অস্বচ্ছ থেকে যাবে, তত দিন বাংলাদেশের ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থেকেই যাবে।

ফয়েজ আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে লাখ লাখ অভিযোগ আছে। হাবিবুল আউয়াল (প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল) স্বীকার করে বলেছেন, প্রায় কোটি অভিযোগ আছে। কয়েক মাস আগে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের ডেটাবেজ হারিয়ে গেছে। ডিজিটাল বায়োমেট্রিক ডেটাবেজে সমস্যা রয়ে গেছে।

অনুষ্ঠানে ফয়েজ আহমদ বলেন, অনেকের আঙুলের ছাপ ঠিকভাবে কাজ করে না। সে জন্য ভোটের দিন ইভিএমে ছাপ মেলাতে সমস্যা হয়। বিষয়টি কমিশন স্বীকারও করেছে।

এক মার্কায় ভোট দিলে অন্য মার্কায় যাবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘এটি প্রোগ্রামিংয়ের বিষয়। সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রামিং আর্কিটেক্টরা যদি বিশেষ দিনে তথা ভোটের দিন সকালে ‘সফটওয়্যার মুড’ পরিবর্তন করে দেন, তাহলে এটা সম্ভব। তবে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রমাণ নেই।’

একটা ডিজিটাল সিস্টেমে যেকোনো সময় ম্যালওয়্যারের (ক্ষতিকর সফটওয়্যার) আক্রমণ হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথাও জানান ফয়েজ আহমদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদিও ইভিএমযন্ত্রে ইন্টারনেট–সংযোগ নেই, কিন্তু এটি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত। নিজস্ব নেটওয়ার্কের মধ্যে কেউ যদি ম্যালওয়্যার দিয়ে আক্রমণ করেন, তাহলে কমিশনের অজান্তেই ঘটনাগুলো ঘটে যেতে পারে।

পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপনায় ফয়েজ আহমদ আরও বলেন, যেখানে নিখুঁত এনআইডি ও বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ তৈরি হয়নি, সেখানে অর্ধেক তথা ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটের যৌক্তিকতা কোথায়? একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য ওই কেন্দ্রের সব ইভিএমে থাকে না বলে একটি ইভিএম হ্যাং করলে, নষ্ট হলে বা একটি ইভিএমের ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে তাঁকে অন্য ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না। জাতীয় নির্বাচনে কর্মকর্তাদের ইভিএমে ওভাররাইড (যদি কোনো ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলে তখন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ব্যালট চালু করে দেওয়ার যে পদ্ধতি) করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি আসনে জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএমে ওভাররাইড করার অনুমতি ফলাফল পরিবর্তনের প্রধানতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

ফয়েজ আহমদ বলেন, ৪ হাজার কোটি টাকা খরচের পর নির্বাচন কমিশন তাদের ‘ইভিএম ভোট করার’ কারিগরি সক্ষমতাকে ৬ থেকে ৭৫টি আসনে উন্নীত করতে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯ বছর সময় নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ৯ বছরে ইসি যেখানে ৭৫ আসনে ভোট করার কারিগরি সক্ষমতা তৈরি করেছে, সেখানে মাত্র এক বছরেই এই সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে পারবে কি না।

আলোচনা সভায় সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ফলাফল সঠিক না হলে ‘ফরেনসিক অ্যানালাইসিস’ করতে হবে। লাখ লাখ যন্ত্রে এটা তো সম্ভব নয়। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন যা বলবে, তাই চূড়ান্ত, কুমিল্লায় যা হয়েছে। যাচাই–বাছাই করার আর সুযোগ নেই। কী উদ্দেশ্যে এটা করছে, তা বোধগম্য নয়। এই মেশিন যে নির্ভুল, এটা দিয়ে যে সঠিক নির্বাচন করা যায়, এটা মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব তাদের, অন্য কারও নয়। কিন্তু তারা একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম আরও বলেন, এর ওপর যেহেতু কারও নিয়ন্ত্রণ নেই এবং এটা ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই বাইরের কেউ কারসাজি করতে পারে না।

কিন্তু পদে পদে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা এবং অধীনস্থ ব্যক্তিরা কিন্তু এটা নিয়ে বিভিন্ন রকম কারসাজি করতে পারেন। ইভিএমের ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাশীলতায়। এখন নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাশীলতা কতটুকু আছে, আপনারা নিজেরাই জানেন। এই ইভিএমের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে তাদের ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা, আস্থাশীলতা আরও কমে গেছে বলে মনে করেন তিনি।

‘আমাদের নির্বাচন কমিশন শুনতেও পায় না, দেখতেও পায় না’—এমন মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো বড় প্রযুক্তিবিদ আর তৈরি হয়নি। তিনি ইভিএম নিয়ে গঠন করা কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে তিনি স্বাক্ষর করেননি। কারণ, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’

আলোচনা সভায় সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, যাঁরা সংলাপে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই ইভিএমের বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও বিষয়টি নিয়ে সংলাপে নরম ছিলেন। হঠাৎ কেন খুঁটি উল্টে গেল বোঝা যাচ্ছে না।