করোনাকালে শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগ-বিপত্তির কারণ মাস্ক

গবেষণায় অংশ নেওয়া শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বলেছেন, যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাস্ক স্পষ্ট একটি পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে
ছবি: রয়টার্স

করোনা মহামারিকালে সারা বিশ্বে মাস্কের ব্যবহার বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মহামারির শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মুখে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তবে প্রচলিত এই মাস্ক আবার শ্রবণপ্রতিবন্ধী অনেক ব্যক্তির জন্য যোগাযোগ-বিপত্তির কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ, মাস্ক পরে থাকা ব্যক্তিদের মুখোভঙ্গি তাঁরা বুঝতে পারেন না। ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাঁরা সমস্যায় পড়েন।

মাস্কের ব্যবহার ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগ সমস্যা নিয়ে এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা মহামারিকালে ৯০ শতাংশ শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে এই সমস্যায় ভুগতে হয়েছে।

শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অন্যের কথা বুঝতে পারার একটি উপায় ঠোঁটের নাড়াচাড়া (লিপ রিডিং) দেখা। পাশাপাশি তাঁরা মুখের ভাবভঙ্গিও দেখেন। তার ভিত্তিতে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ঠোঁট-মুখ যদি দেখা না যায়, তাহলে শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অন্যের কথা বা মনোভাব বুঝতে পারেন না। ফলে তাঁদের জন্য যোগাযোগের সমস্যা হয়।

গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির মনোবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক গুতেরেজ-সিগাট। তাঁরা প্রায় ৪০০ জন শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে গবেষণাটি করেন। গবেষকেরা আশা করছেন, তাঁদের এই গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতিতে নেওয়া নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।

করোনা মহামারিকালে কোথাও দেশজুড়ে বা বিশেষ অঞ্চলে লকডাউন জারি করা হয়। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। করোনার এসব কঠোর বিধিনিষেধ সমাজের সবার জন্যই কঠিন পরিস্থিতি হিসেবে আসে। তবে তা আরও কঠিন হয়ে ওঠে বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এমনিতেই প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। মহামারিকালে মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর। কিন্তু ভয়াবহ বৈশ্বিক সংকটকালে এই সমস্যার দিকটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে মানুষ ব্যাপকভাবে মাস্ক পরায় ৭৬ শতাংশ শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাননি, কিংবা তাদের কাছ থেকে তথ্য ফসকে গেছে।

গবেষণা অনুযায়ী, ৫৯ শতাংশ শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি মনে করেছেন, মহামারিকালে মানুষের মুখ মাস্কে ঢাকা থাকার কারণে তাঁরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা বিভিন্ন বয়সে দেখা দিতে পারে। অনেকের এই সমস্যা দেখা দেয়, বয়স কিছুটা বেড়ে যাওয়ার পর। গবেষকেরা বলছেন, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী যেসব মানুষ এই প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছেন, মাস্কের কারণে তাঁদের যোগাযোগ সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হয়েছে।

আবার স্প্যানিশদের তুলনায় এই সমস্যা ব্রিটিশদের মধ্যে বেশি দেখতে পেয়েছেন গবেষকেরা।

তবে শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা কথার চেয়ে অন্য মাধ্যম, যেমন লেখা, ইশারা ভাষার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন, তাঁদের যোগাযোগ সমস্যা কম হয়েছে।

গবেষণায় অংশ নেওয়া শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বলেছেন, যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাস্ক স্পষ্ট একটি পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। দোকানে নিত্যপণ্য কেনা থেকে শুরু করে চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

আরও পড়ুন

বিশ্বে করোনা মহামারির মতো সংকট হয়তো আবার দেখা দিতে পারে। তখন শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগাযোগ সুবিধার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে? শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেকে গবেষকদের বলেছেন, স্বচ্ছ মাস্ক, অর্থাৎ যে মাস্ক পরার পর ঠোঁট-মুখ দেখা যায়, সেটি তাঁদের যোগাযোগে জন্য সহায়ক হতে পারে।

স্বচ্ছ মাস্ক হয়তো একটি সমাধান হতে পারে। তবে তা একমাত্র সমাধান নয়। ইশারা ভাষার ব্যবহারও একটি সমাধান হতে পারে। তবে এটি সর্বজনীন উপায় নয়। কারণ, শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সবাই একই রকম নন, সবার সমস্যাও এক নয়। তাঁদের চাহিদার পার্থক্য আছে। সুতরাং একটি মাত্র সমাধান সবার জন্য প্রয়োগ করা যাবে না। আর তা কার্যকরও হবে না বলে মন্তব্য গবেষকদের।