পাঠকের লেখা–৪৮
আমার মিনি, আমার পুষি
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসের ২২ তারিখ। সবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেছি। একটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ অবস্থায় গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করছিলাম। সময়টা বর্ষাকাল। গত কয়েক দিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা নদীর পানি বন্যা আকারে গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়েছে। দু–তিন দিনের ভেতর আমাদের বাড়ির উঠানে বন্যার পানি উঠে গেল।
আমি আমার ঘরের বারান্দায় দুপুরের খাবারের পর মাদুর পেতে জোড়াসন হয়ে বসে ছিলাম। এমন সময় দুটি বিড়ালের ছানা ‘মিউ মিউ’ করে এসে আমার দুই পায়ের ওপর বসে পড়ল। কিন্তু এর মধ্যে একটি বিড়াল ক্রমাগত ডাকতে থাকল। তখন লক্ষ করলাম, বিড়ালটির এক চোখে একটি জোঁক ঢুকে রক্ত খাচ্ছে! আমি তৎক্ষণাৎ ওই জোঁক টেনে বের করে ফেললাম। এমন অবস্থায় বিড়ালটা শান্ত হলো কিন্তু আমার পায়ের ওপর থেকে সরল না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি আমার মাকে বলে ওদের জন্য কিছু ভাত-মাছের ব্যবস্থা করলাম। বাচ্চা দুটি খেতে থাকল এবং আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এটা দেখে আমার খুব মায়া হলো।
দুটো বিড়ালছানাই মেয়ে বিড়াল ছিল। আমি ওই ছানা দুটোর নাম দিয়ে দিলাম। একটির নাম মিনি আর আরেকটির নাম পুষি। ওদের মায়ের আর কোনো খোঁজ পেলাম না। হয়তো বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
দিনে দিনে মিনি আর পুষি আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠল। আমি ওদের নাম ধরে ডাক দিলে ওরা সাড়া দিত। ওরা কেমন করে বুঝত, আমি ভেবে পাই না। মিনিকে ডাকলেই আমার কাছে আসত। পুষি তখন দূরে বসেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। যখন আমি আমার পুষিকে ডাকতাম, তখন ও আমার কাছে চলে আসত। ওদের বসার স্থান ছিল আমার দুই পায়ের হাঁটু। প্রতিদিন তিন বেলা ভাত-মাছ ও দুধ খাওয়াতাম নিজ হাতে। রাতে আমি মশারি টানিয়ে শুয়ে থাকতাম। ওরা অনেক রাতে এসে আমার মশারির বাইরে আস্তে করে শুয়ে থাকত। আমি যখন স্নান করতে পুকুরে যেতাম, তখন ওরা আমার সঙ্গে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকত। আবার স্নান সেরে যখন বাড়ির দিকে রওনা দিতাম, তখন ওরাও আমার সঙ্গে বাড়ি চলে আসত।
এভাবে প্রায় বছর কেটে গেল। একদিন আমি বাবার সঙ্গে শহরে গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে। বিকেলে প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল। রাত ১০টার দিকে বাড়ি এসে শুনলাম, ঝড় ছেড়ে যাওয়ার পর একটি কুকুর আমার একটি বিড়ালছানাকে তাড়া করে পাশের বাঁশঝাড়ের দিকে নিয়ে যায়। আমার মা ও বোন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পায় না। আমি তৎক্ষণাৎ বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে ‘পুষি’ বলে ডাক দিতেই মিউ মিউ করে বাঁশঝাড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল। আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম।
এরই মধ্যে আমার জনতা ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার পদে চাকরি হলো। আমার পোস্টিং হলো শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা শাখায়। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসের ১৮ তারিখে চলে গেলাম কর্মস্থলে। মাঝেমধ্যে ছুটিতে বাড়ি আসতাম। তখন মিনি আর পুষি যে কী করবে! অনেক অস্থির হয়ে যেত। মিউ মিউ করতে থাকত আর আমার দুই পায়ের ওপর এসে গড়িয়ে পড়ত। আবার হাত দিয়ে ওদের খাইয়ে দিতাম।
একদিন জানতে পারলাম মিনিকে পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজের দু–তিন দিন পর তার মৃতদেহ একটি জঙ্গলে পাওয়া গেল। মিনির মৃত্যুর প্রায় মাস ছয় পর পুষিও মারা যায়।
এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। এরপর কত দিন কেটে গেছে। কিন্তু মিনি আর পুষির স্মৃতি এখনো আমাকে নাড়া দেয়।
প্রীতিশ কুমার সরকার, ইন্দিরা রোড, ঢাকা