রেডিওথেরাপি এখন আর ভয় পাওয়ার কোনো বিষয় নয়। আধুনিক প্রযুক্তি একে করেছে আরও নিখুঁত নিশানার ও নিরাপদ। রেডিওথেরাপি ক্যানসার ফিরে আসা ঠেকাতে কার্যকর। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে স্তন ক্যানসারের রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে পারেন আগের চেয়ে দ্রুত ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
‘বিশ্বমানের ক্যানসার-চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় অতিথিদের কথায় এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে। নাসিহা তাহসিনের উপস্থাপনায় এ পর্বে অতিথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলোজির সহযোগী কনসালট্যান্ট ডা. অদিতি পাল চৌধুরী ও কনসালট্যান্ট ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা। ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে এসকেএফ অনকোলোজি।
এবারের আলোচনায় রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। পর্বটি রোববার (২৬ অক্টোবর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক জানান, রেডিয়েশন নিয়ে মানুষের আগ্রহ নতুন নয়। প্রায় ১২৫ বছর আগে, ১৮৯৫ সালে জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম রন্টজেন এক্স-রে আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে রেডিয়েশন গবেষণার সূচনা হয়। সেই গবেষণার ফলেই পাওয়া গেছে রেডিওথেরাপি-ক্যানসার কোষ ধ্বংসে ব্যবহৃত এক গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। সময়ের সঙ্গে রেডিয়েশন থেরাপি হয়েছে আরও টার্গেটেড, কার্যকর ও নিরাপদ।
রেডিওথেরাপি কী এবং স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় এর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, রেডিওথেরাপি স্তন ক্যানসার চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সাধারণত সার্জারি ও কেমোথেরাপির পর এটি দেওয়া হয়, যাতে অপারেশনের স্থানে ক্যানসার আবার ফিরে না আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, রেডিওথেরাপি রোগের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর এবং দীর্ঘ মেয়াদে জীবনমান উন্নত করে।
এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান, রেডিওথেরাপিতে ব্যবহৃত রেডিয়েশন কি সুস্থ কোষেরও ক্ষতি করে? জবাবে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, রেডিয়েশন থেরাপি নির্দিষ্টভাবে টার্গেট (নিশানা) করা হয়, তবে শরীরের আক্রান্ত স্থানের আশপাশের কিছু সুস্থ কোষেও অল্পমাত্রায় প্রভাব পড়তে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি এই ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখে।
রেডিয়েশনের ডোজের নির্ধারণপ্রক্রিয়া প্রসঙ্গে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, প্রতিটি রোগীর অবস্থা, সার্জারির ধরন ও শরীরের গঠন অনুযায়ী ডোজ নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্য থাকে, ক্যানসারে আক্রান্ত অংশে সঠিক মাত্রায় রেডিয়েশন দেওয়া এবং আশপাশের অঙ্গ যেমন হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসকে সর্বনিম্ন রেডিয়েশন দেওয়া।
রেডিওথেরাপির সময় রোগীর শরীর থেকে কি রেডিয়েশন ছড়ায়? উপস্থাপকের এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, একদমই না। রেডিয়েশন শুধু থেরাপির সময় শরীরে প্রবেশ করে এবং বাইরে ছড়ায় না। থেরাপি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে বিকিরণ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়।
রেডিওথেরাপি নেওয়ার পর রোগীর পরিবারের কারও ঝুঁকি থাকে কি? উত্তরে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, না, কোনো ঝুঁকি নেই। থেরাপি সেশনের পর রোগীর শরীরে বিকিরণ থাকে না। তাই পরিবারের সদস্যদের সংস্পর্শে আসা পুরোপুরি নিরাপদ।
গর্ভাবস্থা বা স্তন্যদান চলাকালীন রেডিওথেরাপি দেওয়া প্রসঙ্গে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, গর্ভাবস্থায় রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় না, কারণ অল্প মাত্রার বিকিরণও ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে। স্তন্যদান চলাকালীনও এটি এড়িয়ে চলা হয়, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট সময় পর দেওয়া যেতে পারে।
রেডিওথেরাপির যে কক্ষ, তাকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হয়? উত্তরে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, রেডিওথেরাপি একটি বিশেষ সুরক্ষিত বাংকারে দেওয়া হয়। এর দেয়াল বিকিরণরোধী উপাদানে তৈরি। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বিকিরণমাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়।
রেডিওথেরাপির সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, সাধারণত ত্বকের জ্বালা, লালচে ভাব, কালচে হয়ে যাওয়া, শুষ্কতা, দুর্বলতা ও ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিতে পারে। এগুলো অস্থায়ী এবং চিকিৎসকের পরামর্শে সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
ত্বকের লালচে ভাব বা জ্বালার স্থায়িত্ব সম্পর্কে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, এটি সাময়িক। সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেরে যায় এবং ত্বক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
অনেক রোগী নিজের মতো করে লোশন বা ক্রিম ব্যবহার করেন। এ ব্যাপারে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো পণ্য ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, অনেক ক্রিমে রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা বিকিরণপ্রাপ্ত ত্বকে ক্ষতি করতে পারে। জায়গাটি শুকনো ও পরিষ্কার রাখা সবচেয়ে ভালো যত্ন। থেরাপির সময় কী ধরনের পোশাক পরা উচিত? এ বিষয়ে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, সুতি, ঢিলেঢালা ও নরম পোশাক পরা উচিত। টাইট ফিটিং বা ঘর্ষণ হয় এমন কাপড় পরলে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রেডিওথেরাপির পর সূর্যের আলো কত দিন এড়িয়ে চলা দরকার? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, দুই থেকে তিন সপ্তাহ সরাসরি রোদে না যাওয়াই ভালো। এ সময় ত্বক সংবেদনশীল থাকে, তাই ঢেকে রাখা ও সানস্ক্রিন ব্যবহারে উপকার হয়।
রেডিয়েশনের কারণে ফুসফুসের সমস্যা হতে পারে কি না, জানতে চাইলে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, কিছু ক্ষেত্রে সামান্য জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন হালকা কাশি বা শ্বাসকষ্ট। তবে পরিকল্পিত ডোজ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তা সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
রেডিওথেরাপির সময় শরীরে ক্লান্তি ভাব দেখা দেয়। এটি কমানোর উপায় সম্পর্কে ডা. অদিতি পাল চৌধুরী বলেন, পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি পান, হালকা ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম খুব উপকারী। মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকা ও পরিবারের সহযোগিতাও রোগীকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।
‘পারশিয়াল ব্রেস্ট ইরেডিয়েশন’ সম্পর্কে ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা বলেন, এটি এমন একটি আধুনিক পদ্ধতি, যেখানে পুরো স্তনে নয়, শুধু আক্রান্ত জায়গায় রেডিয়েশন দেওয়া হয়। এতে সময় কম লাগে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তুলনামূলক কম হয়।
চিকিৎসা শেষে ফলোআপের সঠিক সময় সম্পর্কে জানান ডা. সুরা যুকরূপ মমতাহেনা। তিনি বলেন, চিকিৎসা শেষের ছয় সপ্তাহ পর প্রথম ফলোআপ করা হয়। এরপর প্রথম বছর দুই-তিন মাস অন্তর, দ্বিতীয় বছর ছয় মাস অন্তর এবং অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত নিয়মিত ফলোআপ রাখা জরুরি।