প্রতিবন্ধী নারীর উন্নয়নে চাই অগ্রাধিকার

রাশেদ খান মেনন, বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ, নবনীতা সিনহা ও আশরাফুন নাহার

অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে নজর দিতে হবে। ঘরে-বাইরে প্রতিবন্ধী নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ও বৈষম্যের শিকার হন। তাই ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আইনি অধিকার পাওয়া, শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধীদের জন্য ইশারা ভাষা বোঝা ব্যক্তিদের যুক্ত করা এবং বিচারকক্ষে বিচারপ্রার্থীদের প্রবেশ করার মতো অবকাঠামোগত ব্যবস্থা করতে হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘প্রতিবন্ধী নারীর সুরক্ষায় আইনি কাঠামো: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শিরোনামে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানান বক্তারা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে পার্টনারশিপ অন দ্য রাইটস অব পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিসের (ইউএন পিআরপিডি) সহায়তায় ইউএন উইমেন, উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ) ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

বৈঠকে বক্তারা আরও বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীদের উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাহিদার ভিন্নতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মানবাধিকারের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিকে সক্রিয় করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে কারিগরি ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে। ভবন, পরিবহন থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বৈঠকে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উন্নয়ন ও অধিকার রক্ষা হয় না। আইনের প্রয়োগ না হলেও কোনো সুফল পাওয়া যায় না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি-সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হতে হবে। তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আবারও সংসদীয় ককাস করা এবং প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত দুটি আসন বরাদ্দ রাখার দাবির প্রতি একমত প্রকাশ করেন।

বৈঠকে অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধিতা অনুবিভাগ) বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ ও ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩’ শিরোনামের দুটি আইন রয়েছে। সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন সম্ভব। জাতীয় পরিবীক্ষণ কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিকে সক্রিয় করার যেসব দাবি সভায় উঠে এসেছে, সেসব নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করবে।

ইউএন উইমেন বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ নবনীতা সিনহা বলেন, বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। তাই কাউকেই পেছনে ফেলে রাখা যাবে না—এই নীতি নিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীদের সুরক্ষায় বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তা নিয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। আইনের প্রয়োগ ও সিআরপিডি বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায় ইউএন উইমেন।

ডব্লিউডিডিএফের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার বলেন, ঘর থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। প্রতিবন্ধী কোটা তুলে দেওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদার ভিন্নতা আছে। সে অনুযায়ী বিচার চাওয়ার সুযোগ নেই। ১৩টি আইন ও পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা রয়েছে। এর মানে হচ্ছে প্রায় প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কিছু না কিছু করার কথা। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে অন্তত দুটি আসন প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য বরাদ্দ করার আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলাদেশের আইনে অধিকারভিত্তিক দিকগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সব প্রতিবন্ধীর জন্য একই রকমের সংকট ও অধিকারের কথা তুলে ধরা হয়েছে। নারী প্রতিবন্ধীরা যে বৈষম্যের শিকার এবং তাঁদের জন্য যে বিশেষ ধরনের মনোযোগ দরকার, তা আইনটিতে নেই।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, প্রতিবন্ধী নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, নির্যাতনের শিকার হলে বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা ও তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয় আনতে হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা যে আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতা ও সামর্থ্য দেখি না। এভাবে আমরা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছি। প্রতিবন্ধী নারীদের চ্যালেঞ্জ আরও বেশি সেটা বিবেচনায় রেখে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় অন্তর্ভুক্তিমূলক আইন করা উচিত।’

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সৈয়দা নাসরীনা পারভীন বলেন, একটু সহায়তা দিলে শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরে অনেক প্রতিবন্ধী নারী প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।

ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ট্রাস্টি মনসুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা দরকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে ২০০৮ সালে জাতীয় পরিবীক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওই কমিটি কাজ করেছিল। তিনি বলেন, ‘ওই কমিটির কেন আর খোঁজ নেই? যে কারও জীবনে যেকোনো সময় প্রতিবন্ধিতা নেমে আসতে পারে। তাই প্রতিবন্ধীদের কখনো কেউ উপেক্ষা করবেন না।’

সেন্টার ফর সার্ভিসেস ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল আলম বলেন, প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির যে ক্ষমতা রয়েছে, সেটাও কার্যকর করা দরকার।

স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ব্লাস্টের আইনবিশেষজ্ঞ (লিঙ্গভিত্তিক ন্যায়বিচার ও নারীর ক্ষমতায়ন) আয়েশা আক্তার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা ফারজানা রেজা, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বাংলাদেশ কর্মসূচি টিম লিড গোলাম ফারুক হামিম, প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনকর্মী নাফিসুর রহমান, ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কর্মসূচি সহায়তা কর্মকর্তা নাজমা আরা বেগম, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ডিজঅ্যাবেলড উইমেনের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার, বি-স্ক্যান–এর পরিচালক ইফতেখার মাহমুদ, সিবিএম গ্লোবাল বাংলাদেশের পরামর্শ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপক দেওয়ান মাহফুজ ই-মাওলা ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক ফারজানা নাজনীন তুলতুল।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।