বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিতে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

ব্লাস্ট আয়োজিত ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: হাইকোর্টের মাইলফলক রায়, সচিবালয় প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা। আজ ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন অডিটরিয়ামেছবি: প্রথম আলো

দেশের বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে আইনজীবী, আইনপ্রণেতা ও নির্বাহী সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। সে জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বার কাউন্সিলের কাঠামোগত সংস্কার এবং আইন প্রয়োগে জবাবদিহির ঘাটতি দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: হাইকোর্টের মাইলফলক রায়, সচিবালয় প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এ কথাগুলো বলেন এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন অডিটরিয়ামে এ সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। অনুষ্ঠান চলাকালে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় করার পদক্ষেপে সরকারের অনুমোদনের খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়।

আলোচনায় বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রশ্নে উদ্বেগ তুলে ধরেন এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইনসভা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ—পরস্পরকে ভারসাম্য রাখার জন্যই গঠিত। কিন্তু বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা প্রশ্নে ‘প্যানিক’ এখনো দূর হয়নি।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রসঙ্গ তুলে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, দেশে এমন বিরল ঘটনা ঘটেছে, একজন প্রধান বিচারপতি রায় দেওয়া বা মতপ্রকাশের কারণে কার্যত পদচ্যুত হয়েছেন। এ ধরনের অভিজ্ঞতা বিচারকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এ ছাড়া বার কাউন্সিলের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, রাজনীতিতে আইনজীবীর ভূমিকার বিষয়গুলো উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচারব্যবস্থায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সৎ, মেধাবীদের নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

আলোচনায় সুপ্রিম কোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল বলেন, ‘আমাদের বিচারকদের মানসিকতাও স্বাধীন হওয়া প্রয়োজন। ন্যায়বিচার ও আইনের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিতে এটি অত্যন্ত জরুরি। আশা করছি, আমরা সঠিক পথে এগিয়ে চলেছি এবং শিগগিরই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাব।’

দেশের অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা (যেমন বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর) উচ্চ আদালতের কাছে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

এ ছাড়া তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে দেশের নিম্ন আদালত ও বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংকটের চিত্রও। তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বর্তমান রূপে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সিদ্ধান্ত বাস্তবে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’—অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয়ের—হাতে থাকে। এই কাঠামো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

দেশের নিম্ন আদালতের বিচারকার্যে গতিশীলতা আনতে পাঁচ হাজার বিচারক প্রয়োজন বলে অভিমত দেন মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, অপর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামোর কারণে বিচারপ্রাপ্তির মান ব্যাহত হচ্ছে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনায় অবৈধ ঘোষিত হওয়া এবং স্বতন্ত্র বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পাওয়ায় আজকের দিনকে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া।

বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করেছিল উল্লেখ করে শরীফ ভূঁইয়া বলেন, এই রায়ের ফলে দেশে কার্যত এক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছিল। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের প্রতি মানুষের আস্থাও টলে গিয়েছিল।

বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠনের প্রসঙ্গ তুলে আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, প্রশাসনিক স্বাধীনতার পাশাপাশি বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করাও জরুরি। তিনি আরও বলেন, বিচারকদের ওপরই সব দায়িত্ব ন্যস্ত করা যাবে না; আইনজীবীরাও এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

অনুষ্ঠান পরিচালনা এবং সমাপনী বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। তিনি বলেন, সরকার সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে, আদালতের মাধ্যমেও যে সংস্কার চলমান, তা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে তিনি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বিষয়ে আদালতের রায়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এ ছাড়া বিচার বিভাগের জন্য গঠিত আলাদা সচিবালয়ে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।