জহির রায়হানের নতুন বই

জহির রায়হান

বাংলাদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন জহির রায়হান। মাত্র ৩৭ বছরের জীবন ছিল তাঁর। কিন্তু এই স্বল্পায়ুর জীবনের বৃহৎ অংশ জুড়ে ছিল দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির তাড়না।

গণমানুষের মুক্তির পথ হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, তা সঞ্চারিত হয়েছিল জহির রায়হানের মধ্যেও। যা তাঁর শিল্পীসত্তা গঠনে রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

আজ ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হানের প্রয়াণদিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে সহোদর শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে বের হয়ে তিনি মিরপুরে হত্যার শিকার হন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজ সোমবার প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছে যখন যন্ত্রণা শিরোনামে জহির রায়হানের অগ্রন্থিত গল্পগ্রন্থ।

যখন যন্ত্রণা অগ্রন্থিত গল্পগুচ্ছ জহির রায়হান

জীবদ্দশায় জহির রায়হানের একটিমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। জহির রায়হানের ছোটগল্পের বড় অংশ গ্রন্থাকারে বের হতে থাকে মূলত তাঁর মৃত্যুর পর। এখনো নানা অনুসন্ধানে তাঁর অগ্রন্থিত ছোটগল্পের খোঁজ মিলছে। এই বই তেমনি একটি অনুসন্ধানের ফল। গল্পগুলো ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে লেখা ও বিভিন্ন পত্রিকায় মুদ্রিত। সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন কাজী জাহিদুল হক। গল্পগুলোর প্রধান উপজীব্য ভাষা আন্দোলন, তত্কালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন, সমাজে নারীর অবস্থান ও নর-নারীর প্রেম। এখানে জহির রায়হানের নিখুঁত সমাজবীক্ষণ ও সচেতন শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যাবে সহজে।

ঢেউ, মনের মতো বউ, অমিত্রাক্ষর, অনমিতা, যখন যন্ত্রণা, অকালসন্ধ্যা ও বেড়ি—সব মিলিয়ে সাতটি অগ্রন্থিত গল্প নিয়ে এই বই। গল্পগুলোতে একটি বিশেষ কাল পর্বের সমাজ ও সেই সমাজের মানুষ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঢেউ গল্পটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত। যেখানে কোয়েটার বাসিন্দা অবাঙালি রিজিয়া সচেতন হয়ে ওঠে নিজের মাতৃভাষার প্রতি। তাকে উজ্জীবিত করে মাতৃভাষার জন্য বাঙালির সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ। গল্পের শেষে এই রিজিয়াকে তাই একাত্ম হতে দেখি আমাদের ভাষা আন্দোলনের অধিকারের দাবির সঙ্গে। সে সালামের বুকে পরিয়ে দেয় ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সংবলিত ব্যাজ। সমাজের মানুষের সার্বিক মুক্তি ও উন্নয়নে পুরুষদের সমানতালে নারীদের চলার বিকল্প নেই। জহির রায়হান তা জানতেন।

বইয়ের অনমিতা গল্প আমাদের এমন এক সংগ্রামী নারীর জীবনে নিয়ে যায় যে শেষ পর্যন্ত অটল থাকে তার আদর্শে। পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির কাছে মাথা নত করে বন্ড দিয়ে জেল থেকে স্বামীর বেরিয়ে আসাকে মানতে পারেনি নীলা। বলেছে, ‘জাফর ভাই, কাচকে হিরে বলে ভ্রম করেছিলাম আমি। জানো, ও একটা কাপুরুষ, আস্ত কাপুরুষ। বন্ড দিয়ে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে।’

মনের মতো বউ গল্পে নারীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গুরুত্ব পেয়েছে। এর বিপরীতে বেড়ি গল্পে উঠে এসেছে সমাজে নারীর শৃঙ্খলিত অবস্থা আর নির্যাতনের চিত্র।

অকালসন্ধ্যা গল্পে পাঠক মুখোমুখি হবেন এমন একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পারিবারিক আবহের, যেখানে প্রতিটি সন্ধ্যা নামে অনিশ্চয়তা, কলহ আর প্রেমহীন হয়ে। আবার অমিত্রাক্ষর ও যখন যন্ত্রণা গল্পে নর–নারীর হৃদয়ঘটিত প্রেম আর না পাওয়ার বেদনা চিত্রায়িত হয়েছে লেখকের অনবদ্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে।

গল্পগুলো পাঠে পাঠক নতুন করে জহির রায়হানের বিরল প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন আরেকবার। যিনি সারা জীবন তাঁর সব সৃজনশীল কর্মে গেয়ে গেছেন মানুষের মুক্তির গান।