আজকের মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ আইজিপির
শাহবাগ থানার মূল ফটকে তালা ঝুলছে। ফটকের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল থানা চত্বরে তিনজন নিরস্ত্র আনসার সদস্য বসে আছেন। কথা বলতে চাইলে একজন এগিয়ে এসে জানালেন, থানার নিরাপত্তার জন্য তাঁদের মোতায়েন করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত আড়াইটা থেকে তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন। এই থানায় কোনো পুলিশ নেই।
শাহবাগ থানায় আনসারের যে দলটি কাজ করছে, তাদের নেতৃত্বে আছেন নায়েক সুবেদার মো. মোজাম্মেল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, থানায় জলকামান, রায়ট কারসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। সেগুলো সুরক্ষায় কাজ করছেন তাঁরা।
রাজধানীর শাহবাগ থানার এই চিত্র গতকাল বুধবার বেলা তিনটার। প্রায় একই পরিস্থিতি রাজধানীর অন্য থানাগুলোরও। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায় থানা আছে ৫০টি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ঘিরে গত সোমবার (৫ আগস্ট) দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ঢাকার থানাগুলো পুলিশশূন্য হয়ে পড়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে।
এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। একই সঙ্গে বৃহস্পতিবারের (আজ) মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এর আগে গত মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবরসহ আরও ১৩টি থানায় যান প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা। এসব থানায়ও মঙ্গলবার কোনো পুলিশ ছিল না। গতকাল এই ১৩টি থানার বিষয়ে আবার খোঁজ নেওয়া হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত কোনো থানাতেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি।
থানার ফটকে তালা
গতকাল রাজধানীর ভাটারা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, শাহবাগ, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ও উত্তরা পূর্ব—এই সাত থানা ঘুরে দেখেছে প্রথম আলো। প্রতিটি থানার মূল ফটকে তালা ঝুলছে। ভেতরে বসে পাহারা দিচ্ছেন আনসার সদস্যরা। তাঁদের কেউ নিরস্ত্র, কেউবা সশস্ত্র।
এর আগে গত মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবরসহ আরও ১৩টি থানায় যান প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা। এসব থানায়ও মঙ্গলবার কোনো পুলিশ ছিল না। গতকাল এই ১৩টি থানার বিষয়ে আবার খোঁজ নেওয়া হয়েছে। বিকেল পর্যন্ত কোনো থানাতেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। অবশ্য এই ১৩টি থানাতেই সোমবার রাতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রায় সব কটি থানা ভবন পুড়িয়ে দেওয়ায় সেখানে কাজ করার মতো পরিবেশ ফিরতে অনেক সময় লাগবে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে।
গতকাল বেলা ১১টায় হাতিরঝিল থানায় গিয়ে দেখা যায় মূল ফটকে তালা ঝুলছে। ফটকের সামনে বসে আছেন পাঁচজন শিক্ষার্থী। তাঁরা বললেন, শিক্ষার্থীরা কোনো থানায় হামলা করেননি। এগুলো দুর্বৃত্তদের কাজ। দুর্বৃত্তদের প্রতিহত করতে তাঁরা থানা পাহারা দিচ্ছেন।
হাতিরঝিল থানাতেও আটজন আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, থানার সম্পদ সুরক্ষার কাজে তাঁদের মোতায়েন করা হয়েছে। তাঁরা শুধু এই কাজটি করছেন। থানার কার্যক্রম কবে নাগাদ চালু হবে, সেটা তাঁরা জানেন না।
গতকাল দুপুরে নিউমার্কেট থানায় গিয়ে কথা হয় আনসার ব্যাটালিয়নের নায়েক সুবেদার মোস্তফা আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর নেতৃত্বে আটজন এই থানায় কাজ করছেন। তাঁদের কাজ হচ্ছে থানায় থাকা সরকারি সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সোমবার বিকেল থেকে দেশের অনেক থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। অনেক জায়গায় অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নথি লুট হয়। এরপর রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশি ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। থানা চালু না থাকায় ডাকাতি, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ বা মামলা এবং জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের আরেক অতিরিক্ত কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারীশ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে কাজ করতে যাতে আর হাত-পা বেঁধে দেওয়া না হয়। জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো না হয়।
পুলিশকে দলীয় কাজে ব্যবহার নয়
পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কোনো দলীয় সরকার যাতে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, সিলেট ও রাজশাহীতে।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনসের ভেতরে বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন শতাধিক পুলিশ সদস্য। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনেকে নিরাপদে চলে গেছেন। আর আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে গেছেন গুলি করতে। এই নির্দেশ মানতে গিয়ে শিক্ষার্থী, জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের।’
দামপাড়া পুলিশ লাইনসের সমাবেশের বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আ স ম মাহতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা যেসব দাবি জানিয়েছেন, সব যৌক্তিক। তাঁদের দাবিগুলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছানো হবে, যাতে বাস্তবায়ন হয়। পুলিশ বাহিনী কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করতে চায় না।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের আরেক অতিরিক্ত কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারীশ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে কাজ করতে যাতে আর হাত-পা বেঁধে দেওয়া না হয়। জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো না হয়।
পুলিশের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম। একই সঙ্গে সংঘর্ষ-সহিংসতায় যেসব ছাত্র, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
আইনে অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পুলিশকে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ময়নুল ইসলাম। একই সঙ্গে সব মেট্রোপলিটন (মহানগর), জেলা, নৌ, রেলওয়ে ও হাইওয়ে থানার কর্মকর্তা ও ফোর্সকে নিজ নিজ পুলিশ লাইনসে বৃহস্পতিবার যোগদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
দায়িত্ব বুঝে নিয়ে গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করেন ময়নুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনে আমাদের পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এ জন্য বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আমি পুলিশপ্রধান হিসেবে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
এই ঘটনার জন্য পুলিশের কিছু কর্মকর্তা দায়ী বলে মনে করেন নবনিযুক্ত আইজিপি। তিনি বলেন, ‘আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত ও নিগৃহীত হয়েছেন।’
মানবাধিকার লঙ্ঘন করা উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে কি না—সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের উত্তরে আইজিপি বলেন, যাঁরা এমন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রবিধানসহ অন্য যেসব আইন ও চাকরিবিধি রয়েছে, সেগুলোর আলোকে প্রশাসনিক এবং আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ সদস্যদের প্রতি নির্দেশনা
সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিওএম, এপিবিএন, সব মেট্রোপলিটন এবং জেলা পুলিশ লাইনসসহ বিশেষায়িত সব পুলিশ ইউনিটের সব কর্মকর্তা ও ফোর্সকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে।
আইজিপি বলেন, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও জেলার পুলিশ সুপাররা নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের থানা এলাকায় জ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেশাজীবী, ছাত্র প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন করবেন। এসব কমিটি থানা ও থানা এলাকার নিরাপত্তা বিধানে আপত্কালীন সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং পরবর্তী সময়ে এর চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে।
পুলিশ সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে আইজিপি বলেন, ‘শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সকল স্তরের সহকর্মীকে সামাজিক মাধ্যমে কোনো প্রকার ব্যক্তিগত, সমিতি, ব্যাচ, অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে কোনো দাবি, মন্তব্য, প্রতি উত্তর প্রদানে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করছি।’
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইজিপির সাক্ষাৎ
অরাজক পরিস্থিতি ও লুটতরাজ বন্ধে পুলিশকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন আইজিপি ময়নুল ইসলাম। এ সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পুলিশকেই এ কাজ করতে হবে।