সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাধানিষেধ দুই বাংলার মানুষের জন্যই ক্ষতিকর

বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিডিআর)। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদান-প্রদান বাধানিষেধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সংগঠনটি বলেছে, এটা দুই বাংলার মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। বাংলাদেশে শান্তি সেনা পাঠানো–সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যেরও নিন্দা জানিয়েছে এপিডিআর।

গত বুধবার দেওয়া পৃথক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে এপিডিআর। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে গত বুধবার কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছে। ওই দিন এক বিবৃতিতে এপিডিআর বলেছে, বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। জানা গেছে, বাংলাদেশের অংশগ্রহণে ভারত সরকারের আপত্তির জন্যই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গ্রহণ করা যায়নি। ভারত সরকারের এই ভূমিকা খুব আপত্তিজনক। একই রকমভাবে আসন্ন কলকাতা বইমেলায়ও বাংলাদেশকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এটাও আপত্তিকর। দুই বাংলার মানুষের পক্ষেই ক্ষতিকর।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূরের সই করা ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক টানাপোড়েন যতই চলুক, দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান–প্রদান কোনোভাবেই বন্ধ হওয়া উচিত নয়। আমরা এ ব্যাপারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ দাবি করছি। সীমান্ত দিয়ে বৈধভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। সেখানে কোনো বাধানিষেধ নেই। অথচ অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে সাংস্কৃতিক আদান–প্রদানে। এপিডিআর সাংস্কৃতিক আদান–প্রদান বন্ধের তীব্র বিরোধিতা করছে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের বাধানিষেধ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের নিন্দা

গত বুধবারই পৃথক বিবৃতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিসেনা পাঠানোর প্রস্তাবের নিন্দা করে এপিডিআর। গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মমতা বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব, কেন্দ্র রাষ্ট্রপুঞ্জের (জাতিসংঘ) কাছে বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠানোর আরজি জানাক।’ এ বিষয়ে একটি লিখিত প্রস্তাবও তিনি কেন্দ্র সরকারকে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন।

মমতার এই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এপিডিআর ওই বিবৃতিতে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলীয় নেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে উগ্র হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের (জাতিসংঘের) শান্তিবাহিনী পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আরজি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের মানুষ অনেক লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। মমতার এই বক্তব্য বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঘাত করবে। ভারতের বিরুদ্ধে বিরূপ অবস্থানে নিয়ে যাবে। একবার শ্রীলঙ্কায় শান্তিবাহিনী পাঠানোর পরিণতি আমরা দেখেছি। ফের সে পথে যাওয়ার চিন্তা মারাত্মক। বলপ্রয়োগের চিন্তা নয়, ভারতের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যা কিছু থাকলে তার সমাধান খোঁজা। অবিলম্বে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসুক ভারত সরকার। তাতে যুক্ত করুক পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও।’

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ১ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে এপিডিআর বলেছে, যে কোনো দেশে ধর্মীয় বা ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার দায় সে দেশের সরকারের। বাংলাদেশে কিছুদিন আগেই দুর্গাপূজার সময় মুসলিম যুবকদের দলবদ্ধ হয়ে হিন্দু মন্দির, মণ্ডপ, মূর্তি পাহারা দিতে দেখা গেছে।

নিজের ইচ্ছামতো ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণ প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু সরকারি বিবৃতি দিয়ে নয়, জাতি-ধর্ম নিরপেক্ষভাবে প্রকৃতই বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে রক্ষা করুক ইউনূস সরকার—এটা এপিডআরের চাওয়া। এপিডিআর মনে করে, ইউনূস সরকার বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারলে ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তি তার পূর্ণ সুযোগ নেবে। তাই সবারই উচিত এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা।

সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত ভারতবর্ষেও

১ ডিসেম্বরের বিবৃতিতে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ভূমিকারও কড়া নিন্দা করেছে এপিডিআর। তারা লিখেছে, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে ভারত সরকার বা বিজেপির কোনো কিছু বলার নৈতিক অধিকারই নেই। ভারতেও সংখ্যালঘু মুসলমান, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের ওপরে লাগাতার নিপীড়ন চলছে। বাদ যাচ্ছে না দলিত, আদিবাসীরাও।’

ভারতে কীভাবে সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক মানুষদের ওপরে অত্যাচার হচ্ছে তারও বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে এপিডিআরের বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, ‘মাত্র কয়েক দিন আগে উত্তর প্রদেশের সম্ভলে ছয়জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে গুলি করে মেরেছে উত্তর প্রদেশ পুলিশ। আবু বকর, ওমর খালিদ, গুলফিসা ফাতিমা, শরজিল ইমামসহ অসংখ্য মুসলমান রাজনৈতিক নেতা ও সমাজকর্মীকে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। ওবিসি রিজার্ভেশন কেড়ে নিয়ে, ওয়াক্‌ফ বিল এনে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি করে, মসজিদের নিচে মন্দির থাকার জিগির তুলে খোঁড়াখুঁড়ি করে সংখ্যালঘুদের বহু অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। বুলডোজার দিয়ে উত্তর প্রদেশ ও আসামে হাজার হাজার সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘর ভেঙে নিরাশ্রয় করা হয়েছে। মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ—কারও জানমাল নিরাপদ নয় আজকের ভারতে।’

এপিডিআর মনে করে, নিজ দেশে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে অন্য দেশের দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য সমান অধিকার চাওয়ার কোনো অধিকার নেই মোদি সরকারের।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের সাধারণ মানুষের ওপরে ভরসা রেখে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ও আদান-প্রদান বাড়ানোর ওপরে জোর দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংগঠনটি। একই সঙ্গে কোনো দেশেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাড়তে না দিতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।