শীতে মৃত্যু বেশি রংপুর ও বরিশালে

২০০৯ থেকে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে রংপুরে। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেশি, শীতও সবচেয়ে বেশি পড়েছে।

আগের রাতে ১২টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়েছেন। চেয়েছিলেন সকালে উঠে আবার বেরোতে। কিন্তু শীতের এমনই কামড় যে প্যাডেল মারা দুঃসাধ্য। অগত্যা রিকশার গদিকে বালিশ বানিয়ে কম্বল গায়ে শুয়ে আছেন রিকশাচালক আবদুল করিম (৫৫)। গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায়, রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায়
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

বাংলাদেশে শীত ও শীতজনিত রোগে বছরে গড়ে ১০৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর হার বেশি সেসব বিভাগে, যেখানে শীত বেশি পড়ে এবং দারিদ্র্যের হার বেশি। 

কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) চারজন শিক্ষকের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে আরও দেখা যায়, দেশে শীত বেশি থাকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে। এই সময়েই মৃত্যু বেশি হয়।

প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে মৃত্যুর হার বেশি রংপুর ও বরিশাল বিভাগে। মৃত্যু একেবারেই কম ঢাকা বিভাগে। উল্লেখ্য, রংপুর ও বরিশাল দরিদ্রঘন বিভাগ। বিপরীতে ঢাকা বিভাগে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম।

বাংলাদেশে ‘শীতের কারণে মৃত্যুর তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা (ডেভেলপিং কোল্ড রিলেটেড মরটালিটি ডেটাবেজ ইন বাংলাদেশ) শিরোনামের গবেষণাটির ফলাফল গত ২৭ সেপ্টেম্বর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ নামের একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়।

জানতে চাইলে গবেষক দলের সদস্য ও কুয়েটের অধ্যাপক মো. মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের যেসব এলাকার মানুষ শীতবস্ত্র বেশি পেয়েছে, সেখানে শীতে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছে। দরিদ্রপ্রবণ এলাকার দরিদ্র মানুষেরা শীতে বেশি মারা যায়। 

১২টি শীত মৌসুমে ১২৪৯ জনের মৃত্যু

গবেষণাটি করা হয়েছে ২০০৯-২০১০ সালের শীত মৌসুম থেকে শুরু করে ২০২০-২০২১ সালের শীত মৌসুম পর্যন্ত ১২টি শীত মৌসুমের তথ্য বিশ্লেষণ করে। গবেষকেরা সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যকে গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। আবহাওয়ার পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত নিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে। বিশ্বব্যাংকের উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার থেকে নেওয়া হয়েছে মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র্য পরিস্থিতির তথ্য। শীতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও হাঁপানি এবং আগুনে পুড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। 

গবেষণাটিতে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের শীত মৌসুমে মোট ১ হাজার ২৪৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১১-২০১২ সালের শীতে, ২১৪ জন। সবচেয়ে কম মৃত্যু হয় ২০১৬-২০১৭ সালের শীতে, ১৮ জন। ২০২০ ও ২০২১ সাল মিলিয়ে যে শীত মৌসুম, সে সময়ে মৃত্যু হয় ৫২ জনের। 

গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন, সাধারণভাবে শীত বেশি পড়লে মৃত্যু বেশি দেখা যায়। শীত মৌসুম শুরুর পর ২১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির ১১ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে শীত বেশি পড়ে। আর ওই সময় শীতে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যায়। তবে বরিশাল বিভাগে শীত মৌসুমের মধ্যে তুলনামূলক উষ্ণ মাসে মৃত্যু বেশি ছিল।

মৃত্যুর বেশির ভাগ, ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ শীত। ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ঠান্ডায় রোগাক্রান্ত হওয়া মৃত্যুর কারণ। ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হওয়া। 

শীতে কাবু মানুষকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গরম পোশাক দেওয়া হয়। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। বহু মানুষ শীতে ভুগতে থাকে। চিকিৎসাসেবার প্রাপ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশুদের স্থান হয়েছে মেঝেতে। কারণ শয্যাসংকট।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ২৬ লাখ ৩৩ হাজার কম্বল দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করেছি। এর বাইরে রংপুরে আলাদাভাবে ৮০ হাজার কম্বল দিয়েছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরও ৪২ কোটি টাকার কম্বল কেনা হচ্ছে। সেগুলো বিলি করা শুরু হলে এবার শীতে মানুষের মৃত্যু অনেক কমে আসবে।’

অবশ্য জানুয়ারি মাসের আট দিন পেরিয়ে গেলেও কম্বল কিনতে না পারা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। 

মৃত্যু বেশি রংপুরে

গবেষকেরা তাদের গবেষণায় দুভাবে মৃত্যুর চিত্রটি দেখিয়েছেন। প্রথমত, প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১২টি শীত মৌসুমে মৃত্যু কত। এ হিসাবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু রংপুরে হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে বরিশাল। এর পরে রয়েছে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও ঢাকা। প্রতি ১ হাজার বর্গকিলোমিটারে মৃত্যুর সংখ্যাও রংপুরে বেশি। এর পরে রয়েছে বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম। 

রংপুর দেশের দরিদ্রপ্রবণ বিভাগের একটি। আবার সেখানে শীতও বেশি পড়ে। গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, রংপুরে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ। সেখানে হতদরিদ্র ২৫ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ। ২০২১ সাল পর্যন্ত আগের ১২টি শীত মৌসুমে রংপুরের সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে। জানুয়ারি মাসে সেখানে গড় তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর শীত বেশি পড়েছে রাজশাহীতে। তুলনামূলক কম শীত দেখা গেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। 

রংপুরে গতকাল রোববার প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে বিতরণ করা কম্বল নিতে লাঠিতে ভর করে এসেছিলেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধা ফুলবি বেগম। তাঁর স্বামী নেই, সন্তান নেই। ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। থাকেন ভাঙাচোরা বাঁশের বেড়ার পুরোনো ঘরে। 

কম্বল হাতে পেয়ে ফুলবি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢোকে। শীতে সারা রাত জেগে থাকতে হয়। একটি কম্বল তাঁর কাছে অনেক কিছু। 

শিশু ও প্রবীণদের মৃত্যু বেশি

শীতে মৃত্যু বেশি হয় শিশুদের। ২০২১ সাল পর্যন্ত আগে ১২টি শীত মৌসুমে যত মানুষ মারা গেছে, তার অর্ধেকের বেশির (৬৩৩টি) বয়স ছয় বছরের কম। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ মারা গেছেন ২৫৫ জন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনাকালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আরও চাপে পড়েছে ২০২২ সালে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ পরিবার খাবার কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে। ফলে তাদের পক্ষে শীতের পোশাক কেনা কঠিন। 

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দেশে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে। এসব মানুষকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের শীতবস্ত্র ও খাবার দেওয়া উচিত।’