বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের পর্যটনে ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে

বিশ্বের মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি দেশে গৌতম বুদ্ধের দেহের নানা অংশ নিশ্চিতভাবেই আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

ঈদের ছুটিতে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে দর্শনার্থীরা। শুক্রবার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের দুটি বৌদ্ধবিহারে গৌতম বুদ্ধের শরীরের নানা অংশ রক্ষিত আছে। এর মধ্যে একটি হলো চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকাননের চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহার। এখানে আছে গৌতম বুদ্ধের শরীরের অস্থি ও কেশ ধাতু (চুল)। আর বান্দরবানের ‘স্বর্ণ মন্দির’ হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধধাতু জাদিতেও আছে বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তার শরীরের অংশবিশেষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি দেশে গৌতম বুদ্ধের দেহের নানা অংশ নিশ্চিতভাবেই আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাকি দেশগুলো হলো মিয়ানমার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন ও থাইল্যান্ড। বাকি কিছু দেশে থাকলেও তা খণ্ডিত। যেসব দেশে এসব নিদর্শন আছে, সেখানে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক যান। কিন্তু বাংলাদেশে এসব বিরল নিদর্শন থাকার কথা খুব কম লোকই জানেন।

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের পর্যটনের বড় বাজার থাকলেও তা প্রায় অবহেলিত। এর জন্য ব্র্যান্ডিং নেই, কোনো প্রোমো তৈরি হয় না। এখন পর্যটনস্থানের কিউআর কোড ব্যবহারের রীতি আছে। এ দেশে তা–ও নেই।
চট্টগ্রামের নন্দনকাননের বৌদ্ধবিহারে গৌতম বুদ্ধের অস্থি ও কেশ ধাতু নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা
ছবি: চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারের সৌজন্যে

সংখ্যা, প্রাচীনত্ব, আকার ইত্যাদি নানা বিবেচনায় বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থাপনা বা স্থানের সংখ্যা অনেক। এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যেসব খননকাজ করে, সেগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ বৌদ্ধধর্মের কোনো না কোনো নিদর্শন। দেশে এসব ঐতিহ্যের এত দর্শনীয় স্থান থাকলেও এর জন্য কোনো প্রচার নেই। অথচ এ দেশে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের পর্যটনের প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

এ অবস্থায় আজ ১৮ এপ্রিল পালিত হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বৈচিত্র্যের আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতা’। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় উপাদান বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান। কিন্তু এর বিকাশে সরকারি উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

দেশের বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানগুলোর একটি হলো নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর বা সোমপুর মহাবিহার। এখানে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন। এর মধ্যে দেড় হাজারের বেশি ছিলেন বিদেশি পর্যটক। আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) এখানে পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। তাঁদের মধ্যে বিদেশি ছিলেন এক হাজার এক শতাধিক।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে আসা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাপানি পর্যটক। তাঁরা বৌদ্ধধর্মীয় স্থান হিসেবে এখানে আসেন। তবে শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের অনেক পর্যটকও এখানে আসতে পারেন। প্রচার থাকলে তা সম্ভব হতো।

ফজলুল করিমের অধীন নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও জয়পুরহাট জেলা রয়েছে। তিনি জানান, এ অঞ্চলে যত খননকাজ হয়, তার মধ্যে বেশির ভাগ বৌদ্ধ ঐতিহ্যসংক্রান্ত। এ অঞ্চলের বড় ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানগুলোও বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন।

গবেষণায় বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মীয় স্থানে পর্যটকের গড় ব্যয় ৮০ থেকে ১০০ ডলার। অর্থাৎ, মোট ব্যয় ৫০০ ডলার বা ৪০ হাজার টাকা। যদি দেড় লাখ পর্যটক বাংলাদেশ পায়, তবে কেবল এ পর্যটন থেকেই বাংলাদেশের আয় হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

উদ্যোগের অভাব

দেশের বৌদ্ধধর্মীয় স্থানের পর্যটনের বিষয়টি নিয়ে প্রায় ১০ বছর আগে আলোচনা শুরু হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার কথা জানায়। তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এই পর্যটনের বিকাশে উদ্যোগী হওয়ার কথা জানান। তবে বিষয়টি আর এগোয়নি।

২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট হেরিটেজ সাইটস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মার্কেটিং’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) তৎকালীন পরিচালক মাসুদ হোসেন। গবেষণায় বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মীয় স্থানে পর্যটকের গড় ব্যয় ৮০ থেকে ১০০ ডলার। অর্থাৎ, মোট ব্যয় ৫০০ ডলার বা ৪০ হাজার টাকা। যদি দেড় লাখ পর্যটক বাংলাদেশ পায়, তবে কেবল এ পর্যটন থেকেই বাংলাদেশের আয় হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

বেঙ্গল ট্যুরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের স্থানগুলোর গুরুত্ব আমাদের নীতিনির্ধারক মহল বোঝেই না। এটি একটি বড় সম্পদ। কিন্তু এর কোনো প্রসারে এখন পর্যন্ত কোনো কাজ শুরু হলো না।’

পর্যটন বোর্ড ২০৪১ সালের মধ্যে সাড়ে ৫০ লাখ বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নিয়ে পর্যটন মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে দেশের ১ হাজার ৪০০টি স্থানের পর্যটনের বিকাশে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আলাদা করে বৌদ্ধধর্মীয় স্থানের বিকাশে পৃথক কোনো পরিকল্পনা নেই।

সুনির্দিষ্টভাবে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের পর্যটনের জন্য আলাদা কোনো কর্মসূচি বাংলাদেশের নেই উল্লেখ করে পর্যটন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. জাবের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে পর্যটনের বিকাশে যে ব্যাপক বিনিয়োগ, তা তো আমাদের নেই। সে ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের বিকাশেও এমন বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু অনেকেই সেটা বুঝতে চান না।’

আয় হতে পারে ৭০০ কোটি টাকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দেব সম্প্রতি বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের স্থানের পর্যটনের একটি গবেষণা করেছেন। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন বৌদ্ধধর্মীয় পর্যটন থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় হয়। কিন্তু এ থেকে ৭০০ কোটি টাকা আয় সম্ভব।

অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দেব প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মীয় ঐতিহ্যের পর্যটনের বড় বাজার থাকলেও তা প্রায় অবহেলিত। এর জন্য ব্র্যান্ডিং নেই, কোনো প্রোমো তৈরি হয় না। এখন পর্যটনস্থানের কিউআর কোড ব্যবহারের রীতি আছে। এ দেশে তা–ও নেই।