ডেঙ্গুতে প্রতি ৬ মৃত্যুর একটি শিশু

ডেঙ্গুফাইল ছবি: প্রথম আলো

এ বছরের প্রায় পুরো সময়জুড়ে ছিল গণমাধ্যমের পাতায় পাতায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর। প্রায় দুই যুগ আগে প্রথম ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় দেশে। তবে এ বছরের মতো মশাবাহিত এই রোগে এত মৃত্যু দেখেনি দেশবাসী। প্রিয়জনকে হারিয়ে বেদনাহত হওয়ার পাশাপাশি ভীত হয়েছেন মানুষজন। ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নিধনে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং শিরায় দেওয়া স্যালাইন (ফ্লুইড) ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) ঘাটতি নিয়েও ছিল ক্ষোভ।

কী হলে কী হতে পারত, সেসব বিতর্ক আর আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে অনেক পরিবার তাঁদের খুদে সদস্য থেকে সবচেয়ে বয়সী মানুষটিকে হারিয়েছে। এমন একটি পরিবার মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তারের। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই দম্পতির দুই শিশুসন্তানের মৃত্যু হয়। গত ১৮ আগস্ট ইব্রাহিম–রাবেয়ার ছেলে আরাফাত হোসেন রাউফ ও পরে ২৫ আগস্ট মেয়ে ইসনাত জাহান রাইদা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

এ বছর ফ্লুইড ও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে এই ব্যবস্থাপনা আরও খারাপ। আর শীতেও দিনের তাপমাত্রা সেভাবে না কমায় এডিস মশার বিস্তার ঘটেই চলেছে। ফলে শিগগিরই ডেঙ্গু থেকে নিস্তারের আশা নেই। আগামী ২০-৩০ বছরে ডেঙ্গু বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ

একই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রাইম ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা, দুই শিশুসন্তানের মা ফারজানা শারমিন। ডেঙ্গুতে শিশু, নারী, পুরুষের এমন অকাল মৃত্যুর উদাহরণ অনেক। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন বাবাকে তাঁর চিকিৎসক মেয়ে প্রতিদিন চিরকুট পাঠাতেন, ‘বাবা, এই লড়াইয়ে তোমাকে জিততে হবে।’ বাবা ডেঙ্গুর কাছে হেরে যান।

এ পটভূমিতে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ এক প্রতিবদেন বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ‘গুরুতর’ উল্লেখ করেছে। গত শুক্রবার প্রকাশিত ‘মানবিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের শুরু থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৬০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৬৪৩ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের হার বেশি, ৬০ শতাংশ। তবে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারী বেশি, এ হার ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ মৃত প্রতি পাঁচজনের তিনজন নারী। আর মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রতি ছয়জনের একটি শিশু।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও কিছু বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেকেই চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের তথ্য জাতীয় ডেটাবেজে নেই।

এ বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী এবং ১৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ। মোট মারা যাওয়া ব্যক্তির মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু ১০ শতাংশ। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

এত নারী–শিশু মৃত্যুর কারণ কী

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির স্বাস্থ্য প্রক্রিয়ায় এটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিক্ষিপ্তভাবে দেখা দেয়।

২০০০ সালে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব হয় দেশে। তখন থেকে বিভিন্ন সময়ে কম–বেশি প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। তবে এবার আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। এ বছর আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী এবং ১৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ। মোট মারা যাওয়া ব্যক্তির মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু ১০ শতাংশ। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে তৈরি জাতীয় গাইডলাইনের প্রধান সম্পাদক কাজী তারিকুল ইসলামের সঙ্গে গতকাল রোববার যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নারী ও শিশু মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আছে। তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তথ্য সংগ্রহ শেষে সেগুলো বিশ্লেষণ করে কারণগুলো বের করা হবে।

১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিক্ষিপ্তভাবে দেখা দেয়। ২০০০ সালে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব হয় দেশে। তখন থেকে বিভিন্ন সময়ে কম-বেশি প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব দেখা দিচ্ছে। তবে এবার আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ।

এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে এই প্রতিবেদককে তারিকুল ইসলাম ইসলাম বলেছিলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যু হওয়ার কারণ হচ্ছে, অনেক সময় মা-বাবারা বুঝতে না পেরে দেরিতে সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। শিশুর দেহ নাজুক, তাদের দেহে পানির ঘাটতি দেখা দিলেই শকে চলে যাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে প্লাজমা লিকেজ দ্রুত হয়। রক্তচাপ চট করে কমে যায়। স্যালাইন দিয়ে রক্তচাপ বাড়াতে চাইলে আবার ফুসফুসে পানি জমে যায়। এটা একটা উভয়সংকট অবস্থা। ওজন দেখে শিশুদের কম বা বেশি ফ্লুইড দিতে হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে–নজির আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নারী ও শিশু মৃত্যু কেন বেশি, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ময়নাতদন্ত করাও প্রয়োজন। যাতে কী কারণে মৃত্যু হচ্ছে, তা বের করা সম্ভব হয়।

শিশু মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বে-নজির আহমেদ বলেন, প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকে আগেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এটা নতুন। যেকোনো পরিবর্তনের সঙ্গে শিশুদের দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দেহের রক্তের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে শিশুরা সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া শিশুদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আক্রান্ত হলে তাদের রক্তনালির ছিদ্র বড় হয়ে যায়। ফলে রক্ত থেকে জলীয় অংশ বেশি পরিমাণে বেরিয়ে যায়। রক্তনালিতে স্বাভাবিক চাপ থাকে না। রক্তচাপ কমতে কমতে শিশুর অবস্থা দ্রুত সংকটাপন্ন হয়ে যায়।  

আর নারীদের ক্ষেত্রে এই জনস্বাস্থ্যবিদের ভাষ্য হলো, নারীদের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য যেসব কারণ ভাবা হচ্ছে তা হচ্ছে— রক্তশূন্যতা, নারীর নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার ঘাটতি ও নারী সদস্যের প্রতি পরিবারগুলোর নজর কম দেওয়ার প্রবণতা। নারীদের মধ্যে রক্তশূন্যতার হার বেশি। ডেঙ্গুতে রক্তের উপাদানের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়, এতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়।

রক্তশূন্যতার ক্ষেত্রেও রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি থাকে। ফলে রক্তশূন্যতা রয়েছে নারীর ডেঙ্গু হলে অক্সিজেনের ঘাটতি বেশি হয়ে বিভিন্ন অঙ্গ অকার্যকর হয়ে যায়। এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দ্রুত শরীর খারাপ হতে দেখা গেছে। নারীস্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীনতায় সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়াও নারীর মৃত্যু বাড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি।  

শহরে–গ্রামে বড় পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে আলাদাভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারে ৪ হাজার ৬২ জন বাংলাদেশি এবং ১৩ হাজার ৪০৭ রোহিঙ্গা আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ বাংলাদেশি ও ১৫ রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

ইউনিসেফ আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু মোকাবিলায় পৌনে ৩ লাখ টেস্ট কিট সরবরাহ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করেছে তারা। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলায় ১৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকার তহবিল ঘাটতি রয়েছে। এই সময়ে নারী, প্রতিবন্ধী ও শিশুদের সহায়তা দেওয়ার জন্য দাতাদের সহায়তা খুব জরুরি।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় শহরে ও গ্রামে বড় পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন বে–নজির আহমেদ। তাঁর মতে, ঢাকায় গত ২০ বছরে সিটি করপোরেশনগুলো এডিস মশা নিধনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার কারণে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে মশা নিধনের ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। গ্রামাঞ্চলের হাসপাতালে যেমন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই, তেমনি রয়েছে চিকিৎসক সংকটও।

আরও পড়ুন

বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘এ বছর ফ্লুইড ও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে এই ব্যবস্থাপনা আরও খারাপ। আর শীতেও দিনের তাপমাত্রা সেভাবে না কমায় এডিস মশার বিস্তার ঘটেই চলেছে। ফলে শিগগিরই ডেঙ্গু থেকে নিস্তারের আশা নেই। আগামী ২০–৩০ বছরে ডেঙ্গু বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’

আরও পড়ুন