সরকারের মধ্যে আত্মসন্তুষ্টি ও অস্বীকৃতির ভাব থাকলে সমস্যা বাড়বে: আনু মুহাম্মদ

রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) বৃহস্পতিবার ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: মানুষ কী ভাবছে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আলোচকেরাছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

সরকারের মধ্যে আত্মসন্তুষ্টি ও অস্বীকৃতির ভাব থাকলে সমস্যা বাড়বে বলে সতর্ক করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেছেন, দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা বেড়েছে। ফলে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে। ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন কী করছে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) আয়োজনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: মানুষ কী ভাবছে’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে পালস সার্ভের (জনমত জরিপ) দ্বিতীয় ধাপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের তিনটি সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, স্বৈরাচারী শাসককে সরাতে পারাটা একটা বড় সাফল্য। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নির্যাতন বন্ধ হয়েছে, এটা আরেকটা বড় সাফল্য। তৃতীয় সাফল্য হচ্ছে, অনেক ধরনের কথাবার্তা, বিতর্ক হচ্ছে, সবাই মতামত দিতে পারছে, অনেক সংগঠন তৈরি হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সবার নামে হত্যা মামলা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃত অপরাধীরা পার হয়ে যাচ্ছে, তাদের জামিন হয়ে যাচ্ছে। আদালত কি স্বাধীনভাবে কাজ করছে নাকি আগের মতোই আদেশক্রমে রায় দিচ্ছে, এটাও মানুষের প্রশ্ন।’

ত্বকী, তনু, সাগর-রুনি, মুনিয়া, কল্পনা চাকমা—আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আলোচিত এই মামলাগুলোর বিষয়ে সরকার সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিলে মানুষের একটা বিশ্বাস আসত যে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে কিছু কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোতে সংস্কারের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে স্বচ্ছতার সঙ্গে নেতা নির্বাচন, শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের অবসরের বয়সসীমা নির্ধারণ, দেশের সব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবিও জানান তিনি।

‘সরকার প্রগতিশীল ও উদার’

আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশকে একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তর ঘটাতে চায়। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নিয়ে যে বদনামটা ভারত থেকে ছড়ায়, যে রকম কথা বলা হয় যে এটা একটা ইসলামিস্ট টেকওভার হয়েছে, কিছু জিনিস কেবল সময়ই বলতে পারে। আমাদের সরকার খুবই প্রগ্রেসিভ ও লিবারেল সরকার। এই সরকার দেশকে খুব ব্রিলিয়ান্টলি একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো আরও এগিয়ে নিতে পারবে।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চোরতন্ত্রের জননী’ আখ্যা দেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এই সরকার অভ্যুত্থানকে দৃঢ়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করছে। কিন্তু এত ভঙ্গুর একটা জিনিস আমরা হাতে পেয়েছি আর এত বড় প্রত্যাশা—এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটা সংগ্রাম আছে। কিন্তু অনেক বছর পর সবাই অনেক স্বাধীনতা পাচ্ছে, অনেক বেশি আওয়াজ। দায়িত্বশীল কথাগুলো যাঁদের মুখ থেকে আসার কথা, তাঁরাও অনেক ক্ষেত্রে জনতুষ্টিবাদী কথাবার্তা বলছেন।’

চার মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যে অর্জন, তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘খুবই অশান্ত একটা দেশকে শান্তভাবে নিয়ে এসে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনার জায়গায় আসতে পেরেছি। এই সরকারের কাজ হচ্ছে, এটাকে সহজতর করা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকার কয়েকটা মেজর কাজ করছে। এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে একটা মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শ্রম আইনে বড় ধরনের সংস্কার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ডিজিটালাইজেশনের কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কাঠামোগত কিছু সংস্কারের কথা ভাবা হচ্ছে। বেসরকারি খাতের সমস্যা নিয়েও তাদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। আমরা কোনো তথ্য ম্যানিপুলেট করছি না।’

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ—এই ধারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তৈরি হচ্ছে বলে দাবি করেন শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে সেপ্টেম্বরের পর পরিস্থিতি নিকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো।...ইউটিউবাররা অনেক ক্ষেত্রে পপুলিস্ট ক্লিকবেটিং এজেন্ডা সেট করে দিচ্ছেন। সেটা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে। আগে তারা যখন হাসিনাবিরোধী ছিল, আমরা হয়তো তালি দিয়েছি। কিন্তু এখন এসে তারা যে ধরনের ফিয়ার মঙ্গারিং (ভয় তৈরি) করছেন, সেটা সত্যিকার অর্থে একটা অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু এটা কোথাও বলা হচ্ছে না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামীকাল (শুক্রবার) থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০টা পণ্যের দাম প্রধান উপদেষ্টার পেজ থেকে দেওয়া হবে—গত বছর কত ছিল, এখন কত।’ সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট বলে বিষয়টাকে সরলীকরণ করা হয়। মূলত সরবরাহ ও জোগানের মিসম্যাচের (ভারসাম্যহীনতা) কারণে এটা হয়। তার সঙ্গে পুলিশ, রাজনৈতিক দলের চাঁদা মিলে দামটা বেড়ে যায়।’

আলোচনায় আরও অংশ নেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহমেদ আহসান, বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মির্জা এম হাসান, নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম, পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ।

সংখ্যালঘু ও নারীদের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আরও সজাগ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ফিরদৌস আজিম। আহমেদ আহসান বলেন, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে সরকারের দৃশ্যমান সক্রিয়তা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারকে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

মির্জা এম হাসান বলেন, মানুষ সরকারের কাছে একটা নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে। রোডম্যাপ না আসায় নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আসছে। মানুষের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সরকারকে যথাযথ নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন ইমরান মতিন।

রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচির বাজেট কোথা থেকে আসছে, সেই প্রশ্নগুলো এখন থেকেই করা উচিত বলে মন্তব্য করেন আইনুল ইসলাম। ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ‘আমাদের সবার সমালোচনাটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সিন্ডিকেট, ভারতসহ যে প্রবণতাগুলো বাধা তৈরি করছে, সেগুলো নিয়ে সেভাবে কথা হচ্ছে না।’