তামাক ব্যবহারে এক বছরে বাংলাদেশের ক্ষতি সাড়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকা

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) কার্যালয়ে দুটি গবেষণার তথ্য উপস্থাপন অনুষ্ঠানে গবেষক ও অতিথিরা। ধানমন্ডি, ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যালয়ের আশপাশে অবাধে বিক্রি হচ্ছে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাকজাত পণ্য। শিশু-কিশোরদের তামাকের প্রতি আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন কৌশল। দোকানে তামাকজাত পণ্য এমনভাবে রাখা হয়, যেন তা শিশুদের নজরে পড়ে। দেশে তামাক ব্যবহারে স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও উৎপাদনশীলতার যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকা।

আজ মঙ্গলবার পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।

অনুষ্ঠানে দুটি গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করা হয়। স্কুলের আশপাশে তামাকজাত পণ্যের বিক্রি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে পিপিআরসি। আর বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও উৎপাদনশীলতার যে অর্থনৈতিক ক্ষতি ঘটে, তার পরিমাণের ওপর গবেষণা করেছে ইকোনমিকস ফর হেলথ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিকস।

দ্বিতীয় গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতি প্রায় ৮৭ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। আর সরকার তামাকজাত পণ্য থেকে রাজস্ব পেয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেই তামাকের কারণে হওয়া ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এই ক্ষতির পরিমাণ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। তামাকের কারণে পরিবেশ সম্পর্কিত ক্ষতিও কম নয়। বন উজাড়, ভূমিক্ষয়, অগ্নিকাণ্ড, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিসহ বিভিন্ন পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে আর্থিক ক্ষতি মোট ক্ষতির প্রায় ১৬ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এখন দেশে এক-তৃতীয়াংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তামাক ব্যবহার করেন। তামাকের প্রভাব শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে না, বরং সামগ্রিক অর্থনীতি ও সমাজের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে।

বিদ্যালয়ের কাছেই মিলছে বিড়ি–সিগারেট

চলতি বছরের ৪ থেক ১৩ নভেম্বর তামাকজাত পণ্যের বিক্রি নিয়ে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে পিপিআরসি। এই গবেষণা করতে গিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা—এই ৪ বিভাগের মোট ১২১টি বিদ্যালয়ের ১০০ মিটারের আশপাশের তামাকজাত পণ্য বিক্রি হওয়ার স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে তারা। এর মধ্যে শহর ও গ্রাম—উভয় এলাকার বিদ্যালয় ছিল। প্রতিটি বিদ্যালয়ের আশপাশের ১০০ মিটারের মধ্যে গড়ে ৫ দশমিক ৫টি তামাকজাত পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চায়ের দোকান, মুদিদোকান, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা ও অন্যান্য।

গবেষণায় উঠে এসেছে, তামাকজাত পণ্যের মধ্যে ৯৯ দশমিক ১ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে সিগারেট বিক্রি হয়। গ্রামীণ এলাকায় ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে বিড়ি পাওয়া যায়। এ ছাড়া গুল, জর্দার মতো ধোঁয়াবিহীন তামাক বিক্রি হয় গড়ে ৫২ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে।

তামাকজাত পণ্যের দৃশ্যমানতাও সমানভাবে উদ্বেগজনক। ১০টির মধ্যে ৭টি বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করা হয়। গ্রামের চেয়ে শহরে তামাকজাত পণ্যের দৃশ্যমানতার হার বেশি। শহরে এই হার ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ আর গ্রামে ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ। তামাকজাত পণ্য প্রদর্শনের হার চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৮৮ দশমিক ৩ শতাংশ আর সর্বনিম্ন হার ঢাকা বিভাগে ৬২ দশমিক ২ শতাংশ।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তামাক বিক্রেতারা শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ কৌশল অবলম্বন করছে। ৮৮ শতাংশ তামাকজাত পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত পণ্য এমনভাবে রাখা হয়, যেন তা শিশুদের চোখের উচ্চতা বা সীমার মধ্যে থাকে। ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে ক্যান্ডি, বিস্কুট ও মিষ্টিজাতীয় পণ্যের পাশে তামাকজাত পণ্য রাখা হয়।

বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপনের হার সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগে ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে এ হার ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ আর সর্বনিম্ন ৫২ শতাংশ খুলনা বিভাগে।

‎এ ছাড়া গবেষণায় এক শলাকা সিগারেট বিক্রির ব্যাপকতা দেখা গেছে। ৯৯ দশমিক ২ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে এক শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়, যা তামাকের সহজলভ্যতা আরও বাড়ায়। খুলনা বিভাগে এই হার শতভাগ। একইভাবে বাজারে এখন বিভিন্ন স্বাদের সিগারেট পাওয়া যায়। এটিও স্কুলপড়ুয়াদের সিগারেটের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

কঠোর নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ

গবেষকেরা তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বেশ কিছু কঠোর নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিক্রয়কেন্দ্রে সব ধরনের তামাকের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণামূলক সামগ্রীর ওপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা জারি করা। স্বাদযুক্ত (ফ্লেভার্ড) সিগারেট এবং এক শলাকা বিক্রির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আজকের এই দুটি গবেষণার উদ্দেশ্য একটাই—তরুণ প্রজন্মকে তামাকের হাত থেকে কীভাবে দূরে রাখা যায় এবং সমাজকে কীভাবে তামাকমুক্ত করা যায়। আমরা বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, এই গবেষণাগুলো পরবর্তী সময়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা করার দিগন্ত উন্মোচন করবে।’

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, তামাক সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি। এটি মোকাবিলায় ধারাবাহিক, প্রমাণভিত্তিক ও কৌশলগত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যুব প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখা একটি জাতীয় দায়িত্ব। এ জন্য আইন সংস্কার এবং কার্যকর তামাক কর কাঠামো অপরিহার্য।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান শারমিন ইয়াসমিন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিকসের প্রভাষক আশরাফুল কিবরিয়া, পিপিআরসির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহকারী মোহাম্মদ ইতেশাম হাসান প্রমুখ।