সাক্ষাৎকার: কেয়ার নিউট্রিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা এডি বেয়ারনট

অগ্রাধিকার হচ্ছে পণ্যের আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা

কেয়ার নিউট্রিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এডি বেয়ারনট। এক যুগ আগে একটা চাকরির প্রস্তাব পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন বাংলাদেশে। এখানকার শিশুদের বিভিন্ন খাবারে পুষ্টির অভাব লক্ষ্য করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এ দেশেই পুষ্টিকর খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শুরু করার।

আগামীকাল ২৮ মে ‘বিশ্ব পুষ্টি দিবস’। এ উপলক্ষে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উঠে আসে পুষ্টিকর শিশুখাদ্য নিয়ে তাঁর ভাবনা ও উদ্যোগের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারেক মাহমুদ নিজামী

কেয়ার নিউট্রিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এডি বেয়ারনট
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশে কেয়ার নিউট্রিশনের যাত্রা শুরু করার ভাবনাটা কীভাবে এল?

এডি বেয়ারনট: বাংলাদেশে চলমান দুটি ধারাকে মাথায় রেখে আমরা কেয়ার নিউট্রিশনের যাত্রা শুরু করেছি। প্রথমত, প্রিমিয়াম জাতের প্যাকেটজাত খাবারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। তাই ভোক্তারা বিদেশ থেকে আমদানি করা খাবার দেশি দামে কিনতে চান। দ্বিতীয়ত, বাবা–মায়েরা পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এবং গুণগত মান ও স্বাদের এমন ধরনের খাবার শিশুদের জন্য চান, যা শিশুর সুস্বাস্থ্য গঠনে ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে শিশুকে করে তুলবে স্মার্ট ও দৃঢ়। কিন্তু শিশুদের জন্য এমন পুষ্টিকর খাবার খুব বেশি নেই। সেই ঘাটতি মেটাতেই সাশ্রয়ী মূল্যে শিশুখাদ্য সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েই আমরা কেয়ার নিউট্রিশনের যাত্রা শুরু করি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাদের ব্র্যান্ডের নাম ‘হাসিখুশি’ ও ‘নিউট্রি প্লাস’ রাখার কারণ কী?

এডি বেয়ারনট: ‘হাসিখুশি’র পণ্য অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে শিশুদের মজার খোরাক দেয়, এর মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করে যেন তারা বেড়ে ওঠে হাসিখুশি এবং প্রাণোচ্ছলতার মধ্য দিয়ে। যার মাধ্যমে আমাদের অঙ্গীকারকেই সবার সামনে তুলে ধরা হয়।
আর ‘নিউট্রি প্লাস’ ব্র্যান্ডের পণ্যগুলো একই সঙ্গে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি নিশ্চিত করে এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। শুধু তা-ই নয়, পুষ্টির উৎস হিসেবে আমাদের স্ন্যাকস, পানীয় এবং কনফেকশনারির খাবারগুলোর মধ্যে মান এবং স্বাদের পাশাপাশি স্থানীয় দামে আমদানি করা বিদেশি পণ্যের মানের খাবার পাচ্ছেন ক্রেতারা, যা পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যবান ও সুদৃঢ় করে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: পাঁচ বছর আগে কেয়ার নিউট্রিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুতে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে?

এডি বেয়ারনট: আমাদের ব্র্যান্ড নিয়ে ভোক্তাদের জানানো এবং আস্থা তৈরি করাটাই ছিল একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। কারণ, এর আগে যে ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের ওপর তাঁরা আস্থা ও বিশ্বাস রাখতেন, সেগুলোর কোনোটি ৩০ বছর, কোনোটি ৫০ বছর এমনকি ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বাজারে রয়েছে। এর মধ্যে গুণগত মান, পুষ্টি এবং দামের সমন্বয়ে নতুন কিছু এনে ভোক্তাদের বিশ্বাস করানোটা বেশ চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু আমরা সেটি সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনারা কীভাবে কেয়ার নিউট্রিশনের পণ্যগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করেন?  

এডি বেয়ারনট: আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে পণ্যের আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করা। আর মান বজায় রাখতে আমরা কারখানায় অনেক উন্নতমানের যন্ত্র ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ করেছি। আমরা বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা দেশি ও বিদেশি মান নির্ধারণী সংস্থা যথাক্রমে বিএসটিআই এবং এসজিএস থেকে  খাদ্য উৎপাদনের জন্য সর্বোচ্চ বৈশ্বিক মান আইএসও ২২০০০: ২০১৮ সনদপ্রাপ্ত। আর এই অর্জন সম্ভব হয়েছে আমাদের কারখানায় ১০ জন ফুড টেকনোলজিস্ট, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স এক্সপার্ট এবং পুষ্টিবিদদের পরিচালনায় গঠিত বিশ্বমানের ল্যাবের কারণে। যেখানে প্রতিটি কাঁচামাল, প্যাকেটজাত খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ আমাদের কারখানায় আসা কোনো কিছুই ল্যাবরেটরির স্ট্যান্ডার্ডের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ছাড়া বাজারজাত হয় না, যা বিএসটিআই এবং ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মান নির্ধারণপ্রক্রিয়ার চেয়েও কঠিন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কেয়ার নিউট্রিশনের পণ্য উৎপাদনে কী ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়? ব্যবহৃত কাঁচামাল সংগ্রহের প্রক্রিয়া কী?

এডি বেয়ারনট: আমরা সর্বোচ্চ মানের কাঁচামাল ব্যবহার করি, যার ৯৫ শতাংশই আমদানি করা। যদি কখনো নতুন কোনো সরবরাহকারীর কাছ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহের প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই সরবরাহকারী আমাদের নির্ধারিত মান নিশ্চিত করেছেন কি না, তা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এবং প্রতিটি কাঁচামাল কারখানায় পরীক্ষা করার পরই সেগুলো পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনার লক্ষ্য অর্জনে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে কি সহযাত্রী হিসেবে সঙ্গে নিয়েছেন?

এডি বেয়ারনট: কিছু চমৎকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সাম্প্রতিককালে আমরা বাংলাদেশ সরকারের অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ থেকে বিনিয়োগ পেয়েছি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি আহমেদ আমাদের আন্তরিক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদেরও একজন সদস্য।
আমার জানামতে, জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে বাংলাদেশ সরকার, যা আমাদের লক্ষ্য ও আদর্শকে সমর্থন করছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।

এ ছাড়া আমরা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকেও অনুদান পেয়েছি, যা অন্তঃসত্ত্বা এবং যে মায়েরা বুকের দুধ খাওয়ান তাঁদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রতিরোধ ও চিকিৎসার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। এ কাজে আমরা আইসিসিডিডিআরবির একদল গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীর সঙ্গে একটি অভিনব ফর্মুলার মাধ্যমে পণ্যের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করছি। এই উদ্যোগ বাংলাদেশে অপুষ্টির চিকিৎসা ও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আমরা দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় এফএমসিজি (ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস) প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের ব্র্যান্ডের অধীনে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলোর উন্নয়ন ও উৎপাদনে সহযোগিতা করেছি। এর মধ্যে রয়েছে এসএমসি (ফ্রুটি, সুপারকিড), অলিম্পিক (সিপো), ড্যান ফুডস (ব্রীজ) এবং গ্রামীণ ড্যানোন (শক্তি+টেস্টি স্যালাইন ও সফট ড্রিংক পাউডার)। ভোক্তাদের জন্য আরও পুষ্টিকর পণ্য তৈরি করতে অন্যদের প্রতি আমাদের সমর্থন বাড়াতে পেরে আমরা আনন্দিত।  

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ২৮ মে ‘বিশ্ব পুষ্টি দিবস ২০২৩’। এ উপলক্ষে পাঠকদের কী বার্তা দিতে চান?

এডি বেয়ারনট: স্বাস্থ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পুষ্টি। শিশুদের শিক্ষা এবং লাইফস্টাইলের মতো পুষ্টিও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বাবা-মা, শিক্ষক এবং নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করা দরকার। একই সঙ্গে সাশ্রয়ী মূল্যে পুষ্টিকর পণ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াও তাদের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।

কেয়ার নিউট্রিশন বিশ্বাস করে, প্রত্যেকেরই পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের অধিকার রয়েছে। আমরা এমন পণ্য তৈরি করার চেষ্টা করেছি, যা প্রতিটি শিশু পছন্দ করবে এবং প্রতিটি বাবা-মা আস্থা রাখতে পারবেন। বাংলাদেশে সুস্থ, সুখী এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখা একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভিন্ন একটা প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে আয়েশি জীবন ছেড়ে ১২ বছর ধরে আপনি বাংলাদেশে আছেন। শিশুসহ সব বয়সী মানুষের জন্য পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাদ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো দায়বদ্ধতা আপনার এই কাজে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে?

এডি বেয়ারনট: অনেকেই আমার কাছে জানতে চান, আমি কেন বাংলাদেশে এসেছি? উত্তর হলো: সৌভাগ্য! হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে গবেষণাধর্মী একটা চাকরির জন্য আমাকে একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তার দুই সপ্তাহ পরে আমি বাংলাদেশে আসি। সেটা ছিল ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস।

আমাকে অনেকেই এটাও জিজ্ঞেস করেন, কেন আমি বাংলাদেশে থাকতে পছন্দ করি? আমার উত্তর হলো: ভালোবাসা। আমি এই দেশের প্রেমে পড়েছি। শুধু দেশের নয়, এখানকার মানুষের উদারতা, সংস্কৃতি, আতিথেয়তা এবং সুস্বাদু খাবার আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই সঙ্গে আমি অভিভূত, যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে এখানকার মানুষের খাপ খাওয়ানোর অবিশ্বাস্য শক্তি দেখে। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনায় ভরপুর একটি ক্ষেত্র, যেখানে তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ জীবনযাপনের সুযোগ রয়েছে। আর পরিবারের সহযোগিতা থাকায় এখানকার মানুষ নতুন কিছু তৈরি করে জীবনে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করে।

এখানে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পেরে আমি সৌভাগ্যবান। তাই আমি এ দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশেষ করে আমার বন্ধু এবং সহকর্মীদের ধন্যবাদ, যারা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এখন আমার অনুভূতি হচ্ছে—আমি আমার ঘরেই আছি!

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ধন্যবাদ আপনাকে।

এডি বেয়ারনট: আপনাকেও ধন্যবাদ।