আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে, এমন নির্মম ছবি দেখিনি: হাইকোর্ট

তালগাছ নিধনে এভাবে গাছ কেটে কীটনাশক দেওয়ার ছবি আজ উচ্চ আদালতে উপস্থাপন করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

তালগাছ সৌন্দর্যময় ও সম্পদ উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেছেন, আমাদের সমাজে বসবাসকারী কিছু পশু সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থে গাছগুলো নষ্ট করছে। দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য রাষ্ট্র একটি বাড়ির মতো, যা সাজানো হচ্ছে আমাদের কাজ। প্রতিটি মানুষই রাষ্ট্রের একটি অংশ। নিজেকে যদি এভাবে প্রস্তুত করা যায়, তাহলে দেশটা অনেক সুন্দর হবে। আইন দিয়ে সবকিছু ঠিক করা যাবে না, যদি না নিজেরাই সচেতন ও সতর্ক হই।

বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার এসব কথা বলেন। রাজশাহীর বাগমারার বাইগাছা এলাকায় ৫০টি তালগাছ মেরে ফেলার জন্য কীটনাশক প্রয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাহরিয়ার আলম আদালতে হাজির হয়েছিলেন। এ–সংক্রান্ত শুনানিতে আদালত ওই কথা বলেন।

‘৫০ তালগাছে কীটনাশক’ শিরোনামে গত ৩১ জানুয়ারি প্রথম আলোয় সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এটি নজরে আসার পর ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। এ অনুসারে আজ আদালতে হাজির হন শাহরিয়ার আলম। তাঁর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. জাহেদুল হক। আদালতের আদেশ অনুসারে সরেজমিনে উল্লেখিত গাছগুলোর ছবিসহ তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আদালতে উপস্থিত হন বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক। আদালত কৃষি কর্মকর্তার বক্তব্য শোনেন। আদালতের মৌখিক আদেশে কয়েক ঘণ্টা আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাহরিয়ার আলম।

হলফনামা আকারে কৃষি কর্মকর্তার প্রতিবেদন ও ছবি আদালতে দাখিল করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস-আল-হারুনী, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজা বেগম ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আনিচ উল মাওয়া। প্রকাশিত খবরের সত্যতা জানাতে প্রথম আলোর পক্ষে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার সময়ের আরজি জানান।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শাহরিয়ার আলম এভাবে তালগাছে কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ
ছবি: সংগৃহীত

ঘটনায় সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে শাহরিয়ারের পক্ষ থেকে শুনানিতে দাবি করা হয়, বিদ্বেষপ্রসূত ঘটনাটি প্রচারিত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষি কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভাষ্য, আমগাছ বাড়াতে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য তালগাছগুলো ক্ষত সৃষ্টি করে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মারার অপচেষ্টা হয়েছে। তালগাছ রক্ষার্থে তার কোনো উদ্যোগ ও আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি। তালগাছগুলোর ক্ষতি করার পেছনে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ রয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে শাহরিয়ার জড়িত মর্মে কৃষি কর্মকর্তা মনে করেন।

সকালে ওই তালগাছগুলোর ছবি আদালতে দাখিল করা হয়। আদালতে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ও আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হককে ছবিগুলো দেখতে বলেন আদালত। এ সময় আদালত বলেন, একজন বৃদ্ধ লোক প্রকৃতি ও দেশকে ভালোবেসে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। এই জাতির যেমন সুসন্তান ও বীরশ্রেষ্ঠ আছে। আবার কুলাঙ্গারও আছে। বাকল কেটে বিষ প্রয়োগ করে, পত্রিকায় দেখেছি। সুপ্রিম কোর্টকে জাগ্রত বিবেক বলা হয়। যে কারণে রাত আড়াইটায়ও আদালত আদেশ দেন।

আদালত আরও বলেন, মনে করছেন—ছোট্ট একটি তালগাছ, এটিও কোর্ট দেখে। প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প যে তালগাছ লাগানো। একজন বৃদ্ধ মানুষ, বাবার বয়সী মানুষ, উনি আগামী দিনের জন্য সন্তানদের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে তালগাছ লাগিয়েছেন। অথচ কুসন্তান বিষপ্রয়োগ করেছে—এরা দেশকে কী দিল?  

মধ্যাহ্ন বিরতির পর শুনানিকালে আদালত বলেন, একটি পশুরও মায়া থাকে। পশুরও একটা অনুভূতি থাকে। একটি গাছ হতে ১২ বছর সময় লাগে। ১২ বছর কে ফিরিয়ে দেবে? গাছের জীবন আছে। ইচ্ছা করলে একটি গাছ সৃষ্টি করতে পারবে না। এই পশুদের চিহ্নিত করাই হচ্ছে কাজ। সে পশু যে–ই হোক না কেন, যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন? এটি হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই। গাছের যে ছবি দাখিল করা হয়েছে, আমাদের হৃদয় ভেঙে গেছে। এমন নির্মম ছবি দেখিনি।

ওই ঘটনায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) বরাবর গত ৩০ জানুয়ারি চিঠি পাঠান বলে শুনানিতে উঠে আসে।

শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ওই জিডির ভিত্তিতে কী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বাগমারা থানার ওসিকে ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির হয়ে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম আলোর বাগমারা প্রতিনিধিকে সেদিন আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। কথোপকথনের রেকর্ডসহ তাঁকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। সেদিন প্রথম আলোকে ওই প্রতিবেদনের সত্যতাও জানিয়ে হলফনামা দিতে বলা হয়েছে। শাহরিয়ার আলমকেও ওই দিন আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। সেদিন পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য দিন রেখেছেন আদালত।