মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছিল দুই শিশু, ফিরল তাঁর লাশ নিয়ে

মো. জামাল ও আঞ্জুয়ারা দম্পতি। আজ গাজীপুরে পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে আঞ্জুয়ারা মারা গেছেন
ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে স্বল্প বেতনে আলাদা পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মো. জামাল ও মোসা. আঞ্জুয়ারা খাতুন দম্পতি। ইচ্ছা থাকলেও দুই সন্তানকে কাছে রাখার সামর্থ্য তাঁদের নেই। আট বছর বয়সী ছেলে মো. আরিফ ও সাত বছর বয়সী মেয়ে জয়া খাতুন গ্রামে তাদের দাদা-দাদির কাছে থাকে। সেখানেই একটি বিদ্যালয়ে আরিফ তৃতীয় শ্রেণিতে এবং জয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পূজার ছুটিতে ২০ দিন আগে মা–বাবার কাছে বেড়াতে এসেছিল দুই ভাই-বোন। আজ বুধবার মা আঞ্জুয়ারার লাশের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের চরগিরিশ গ্রামে ফিরতে হলো ছোট্ট আরিফ ও জয়াকে।

সকালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে আঞ্জুয়ারা খাতুনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর স্বামী মো. জামাল বলেছেন, আঞ্জুয়ারা শ্রমিক বিক্ষোভে ছিলেন না। বিক্ষোভের কারণে সকাল আটটার দিকে কারখানা ছুটি হওয়ার পর জরুন এলাকার বাসায় সন্তানদের কাছে ফিরছিলেন আঞ্জুয়ারা। পথে কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় পুলিশের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আঞ্জুয়ারার লাশের সুরতহাল করা হয়। পরে তাঁর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যার পর স্বজনেরা অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে রওনা দেন। আঞ্জুয়ারার দুই শিশুসন্তানও মায়ের লাশের সঙ্গে ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়ির পথে রওনা হয়।

আঞ্জুয়ারার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্জুয়ারার মাথায় গুলির আঘাতের কোনো চিহ্ন তিনি পাননি। তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে মনে হয়েছে, হুড়োহুড়ির সময় তিনি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন মানুষের পায়ের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

আঞ্জুয়ারাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনার পর রেজিস্টারে ‘গুলির আঘাতজনিত’ সমস্যায় আহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই আঞ্জুয়ারা মারা যান। তাঁকে জরুরি বিভাগে আনার পর স্বজনেরা বলেছেন, গুলিতে আহত হয়েছেন। সেটিই প্রাথমিকভাবে রেজিস্টারে লেখা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক খতিয়ে দেখবেন।

সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে কথা হয় আঞ্জুয়ারার স্বামী জামালের সঙ্গে। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি তখন স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। জামাল প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্জুয়ারা ইসলাম গার্মেন্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। আর তিনি নিজে কাজ করেন ডিজাইন প্রিন্টিং নামে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে। প্রতিদিনের মতোই গতকাল সকাল সাড়ে ছয়টায় তাঁরা বাসা থেকে কারখানার উদ্দেশে রওনা দেন। আঞ্জুয়ারাকে কারখানায় তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জামাল বলেন, পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তিনি কারখানা থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর খোঁজ নিতে যান। কারখানার সামনেই আঞ্জুয়ারার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সকাল আটটার দিকে মাইকে আঞ্জুয়ারার কারখানা ছুটির ঘোষণা আসে। তখন স্ত্রীকে বাসায় যেতে বলেন জামাল। বাসায় যাওয়ার সময় হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়। একটি গুলি এসে আঞ্জুয়ারার মাথায় লাগে। প্রথমে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম আশরাফ উদ্দিন রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিক্ষোভের সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন পোশাকশ্রমিকেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় পড়ে গিয়ে আহত হন আঞ্জুয়ারা। কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তা জানতে পারেননি।

স্বজনেরা জানান, জামাল ও আঞ্জুয়ারার বিয়ে হয় ২০১৪ সালে। তাঁরা দুজনই তখন তেজগাঁও এলাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। দুই বছর আগে তাঁরা গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার দুটি কারখানায় কাজ নেন।

জামাল জানান, দুজন মিলে প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকায় সন্তানদের নিয়ে চলা সম্ভব নয়। সে কারণে ছেলে-মেয়েদের দাদাবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বিদ্যালয় ছুটি হলে অল্প দিনের জন্য দুই সন্তানকে নিজেদের কাছে রাখতেন। চার বছর আগে আঞ্জুয়ারার বাবা মো. মন্টু মারা যান। আঞ্জুয়ারার ছোট দুই ভাইকে নিয়ে মা মাজেদা খাতুন সিরাজগঞ্জে থাকেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁদের দেখভালের দায়িত্বও নিয়েছিলেন আঞ্জুয়ারা।

আরও পড়ুন