‘বাধ্যতামূলক’ অবসরে পাঠানো সচিব মকবুল হোসেন যা বললেন

সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কক্ষে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো মকবুল হোসেন। সোমবার দুপুরে, সচিবালয়, ঢাকা
ছবি: মোশতাক আহমেদ

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে কেন ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরে পাঠানো হলো, তার কারণ এখনো স্পষ্ট করেনি সরকার। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার বছরখানেক আগে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে এভাবে বিদায় দেওয়া নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমেও তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও আর্থিক কারণের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ তথ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কারও সঙ্গে দূরত্বের কথাও বলছেন। তবে যাঁকে ঘিরে এসব আলোচনা চলছে, সেই সচিব মকবুল হোসেন এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।

নিজেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখার সাবেক সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে মকবুল হোসেন আজ সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যত দিন বেঁচে আছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই বেঁচে থাকব।’

আরও পড়ুন

গতকাল রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে আকস্মিকভাবেই সচিব মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানোর কথা জানানো হয়। যখন এ খবর তথ্য মন্ত্রণালয়ে যায়, ওই সময় মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় ছিলেন মকবুল হোসেন। তথ্যসচিবের দপ্তরের একজন কর্মকর্তা সেই সভায় গিয়ে তাঁকে নিজের কক্ষে ডেকে এনে খবরটি জানান।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী, জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে সচিব মকবুল হোসেনকে অবসর প্রদান করা হলো। ওই ধারাতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাঁকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে যে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে।

মকবুল হোসেনের চাকরির মেয়াদ ছিল আগামী বছরের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। তাহলে এখন কেন তাঁকে অবসরে পাঠানো হলো, গতকাল থেকেই সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সচিবালয়ে দায়িত্বরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। তবে সরকারের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। এ বিষয়ে সকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তবে তিনিও স্পষ্ট কিছু বলেননি। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, সচিবকে অবসরে পাঠানোর অন্তর্নিহিত কারণ তিনি জানেন না। অন্তর্নিহিত কারণ বলতে পারবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এ অবস্থায় আজ দুপুরের দিকে সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে আসেন মকবুল হোসেন। তখন সাংবাদিকেরা তাঁর বক্তব্য নিতে যান। এ সময় তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে কখনো কখনো আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, প্রজ্ঞাপনে অবিলম্বে এই আদেশ কার্যকরের কথা থাকলেও কার্যত এটি গতকাল থেকেই কার্যকর হয়েছে। তিনি ব্যক্তিগত কাগজপত্র রেখে গিয়েছিলেন, সেগুলো নিতে এসেছেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মকবুল হোসেন বলেন, এটি (অবসরে পাঠানো) সরকারের সিদ্ধান্ত। সরকার যে কাউকেই এটি করতে পারে। এটা সরকারের অধিকার, স্বাভাবিক ঘটনা। এটা আগেও হয়েছে। চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে সরকার যে কাউকে অবসরে পাঠাতে পারে। একজন সরকারি কর্মচারীর জন্য এটি অবশ্যই শিরোধার্য। তিনি বলেন, ‘সরকারের আদেশ আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছি।’

মকবুল হোসেনকে ঘিরে যেসব আলোচনা চলছে, সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি যত দিন এখানে কাজ করেছি, সততার সঙ্গে করেছি। আমার জানা নেই বা জ্ঞানের ভেতরে নেই, আমার কোনো অপরাধ ছিল কি না বা কোনো অপরাধের কারণে অবসরে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার এটি পারে, আইনের মধ্যেই পারে।’

সরকারবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ অস্বীকার করে মকবুল হোসেন বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করতে পারেন যে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তথ্যসচিবের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কি না। যদি থেকে থাকে, তাহলে সেটি আপনারা প্রচারও করতে পারেন। আমার পক্ষ থেকে কোনো অসুবিধা নেই।’

মকবুল হোসেন বলেন, তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর বয়স যখন ৯ বছর, তখন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর নিজের বাড়িতে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাঁর ভাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন। বাকি জীবনেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে চলবেন তিনি।

একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কথা উল্লেখ করে মকবুল হোসেন বলেন, ‘একটি পত্রিকায় লিখেছে, পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের বিপরীত পাশের একটি বেসরকারি অফিসে নাকি আমার যাতায়াত ছিল। আমি জানি না কোথায় অফিস আছে বা আমি কোনো অফিসে গিয়েছি কি না।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে মকবুল হোসেন বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কখনো সামনাসামনি দেখেননি এবং দেখার ইচ্ছাও নেই।

আরেক প্রশ্নের জবাবে মকবুল হোসেন বলেন, মন্ত্রীর সঙ্গে কেন দূরত্ব থাকবে? তাঁরা সবাই মিলেই কাজ করেছেন। তাঁর নিজের কোনো অনুযোগ নেই। আর শোনা কথা বিশ্বাস না করাই ভালো।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজমের সইয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠানোর কথা জানানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম প্রথম আলোকে বলেন, বিধান আছে, চাকরি মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে কেউ স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারেন। আবার সরকার ইচ্ছা করলেও কাউকে অবসর দিতে পারে। বিধিবিধান মেনেই মকবুল হোসেনকে অবসর দেওয়া হয়েছে। এর বেশি তাঁর পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।

মকবুল হোসেন ২০২১ সালের ৩১ মে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে যোগ দেন। এই পদে যোগ দেওয়ার আগে তিনি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন মকবুল হোসেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী।

আরও পড়ুন