জন্মদিনেই চার বছরের মেয়ে আফসিকে দাফন করলেন বাবা

চার বছর বয়সী এই সন্তানকে হারিয়ে বাবা মামুনুর রশীদ যে শোক প্রকাশ করেছেন, তা বহু মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে
ছবি: মামুনুর রশীদের সৌজন্যে

মাত্র চার বছরের মেয়ের পক্ষ থেকে বাবা লিখেছেন ‘আফসির খোলাচিঠি’। চিঠিটি ফেসবুকে শুধু আফসির প্রিয়জনই নন, অন্যরাও শেয়ার দিচ্ছেন। ৬ অক্টোবর ছিল আফসির জন্মদিন, ‘বার্থ ডে’ কেক খেতে চেয়েছিল। মামির কেনা শাড়ি পরে জন্মদিনে ছবি তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু জন্মদিনেই আফসির দাফন হয়েছে। ছোট মেয়েকে কবর দিয়েছেন বাবা মামুনুর রশীদ।

এত ছোট মেয়েকে কেউ নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে, এটাই বিশ্বাস করতে পারছেন না হুজাইফা নুসরাত আফসির বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (পুর প্রকৌশলী) মামুনুর রশীদ। মেয়েকে হত্যা করার কোনো কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না। মেয়ের কানে তিন আনা সোনা দিয়ে বানানো কানের দুল ছিল। লাশ উদ্ধারের পর দেখা যায়, দুলের জায়গায় আফসির বাঁ কানটা ছেঁড়া। কানের দুল ছিল না কোনো কানেই। মুখে স্কচটেপ লাগানো ছিল। গলা টিপে ধরেছিল, তেমন দাগও ছিল।

মামুনুর রশীদ বললেন, ‘মেয়ের মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। বিচার না পেলে তো মেয়েও আমাকে ক্ষমা করবে না। আমি চাই, যারা আমার মেয়েকে হত্যার সঙ্গে জড়িত, তারা কঠোর শাস্তি পাক। আবার কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে এ মামলায় শাস্তি না পায়, তা–ও চাই।’

মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এলাকায় খোঁজ নেন, আমার কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল না, মনোমালিন্য ছিল না। তারপরও মেয়েটাকে এত কষ্ট দিয়ে মারল কেন? জন্মদিনেই মেয়েকে দাফন করলাম। আমার মেয়ে তো কোনো দোষ করেনি, মনকে তো বোঝাতে পারছি না। কেন এমন হলো?’

কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালীতে ফরিদ আহমেদের বাড়ির নিচতলায় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মামুনুর রশীদ ভাড়া থাকতেন। নিজেদের বাড়ি বানানোর কাজ হচ্ছে বলে পরিবার নিয়ে এ বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তিনি। এ ভাড়া বাড়ি লাগোয়া পুকুর থেকেই ৫ অক্টোবর উদ্ধার করা হয় তাঁর মেয়ের লাশ।

হুজাইফা নুসরাত আফসি, ৬ অক্টোবর ছিল মেয়েটির চতুর্থ জন্মদিন। তার আগের দিন বাসাসংলগ্ন পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়
ছবি: মামুনুর রশীদের সৌজন্যে

গত মঙ্গলবার বিকেলে ফোনে কথা হয় মামুনুর রশীদের সঙ্গে। ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয় মেয়ের লাশ। ৬ অক্টোবর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মামুনুর রশীদ বললেন, ‘মেয়েটা মরে যাবে বলেই মনে হয় তাকে বেশি আদর করতাম। সে–ও বাবা ও মায়ের মাঝখানে শুয়ে ঘুমাত। গত মাসে জন্ম নেওয়া ভাই তাকে আপু ডাকবে, এ খুশিতে থাকত। আড়াই বছর আগের একটি ছোট ভিডিওতে আফসি বাবা, বাবা বলে ডাকছে। অস্পষ্টভাবে আরও অনেক কিছু বলার চেষ্টা করছে, কত স্মৃতি।’

মামুনুর রশীদ বলেন, কানের দুলের জন্য না অন্য কোনো কারণে মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। ৪ অক্টোবর মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। একটি দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মেয়ে পাশের বাসার আরেকটি ছোট মেয়ের সঙ্গে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর লাগোয়া দোকান থেকে চকলেট কিনে বাড়ির গেটের ভেতরে ঢোকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। তারপর মেয়ে আর বাড়ির বাইরে যায়নি।

বাড়িওয়ালা পরিবার নিয়ে ভবনের দোতলায় থাকেন। তিনি সৌদি আরবে ছিলেন দীর্ঘদিন। এক ছেলের জন্ম সৌদি আরবেই। বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে আফসি দাদি ডাকত। তিনিও মেয়েকে আদর করতেন। তাই এই পরিবারের সদস্যরা মেয়ের কোনো ক্ষতি করতে পারে, সে সন্দেহ করেননি মামুনুর রশীদ। তবে পরে জানা গেল, মেয়েকে হত্যার পেছনে বাড়িওয়ালার স্ত্রী, ছেলেসহ অন্যরা জড়িত। পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন। টেকনাফ থানায় করা মেয়ে হত্যা মামলায় বাড়িওয়ালার স্ত্রী, ছেলেসহ সাত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

মামুনুর রশীদ জানালেন, মেয়ে নিখোঁজের পর পুকুরে কয়েক দফায় লোক নামিয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়। ৫ অক্টোবরও এক দফা খোঁজা হয়। দুপুরের পরে এই পুকুরেই আফসির লাশ পাওয়া যায়। তবে দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকলে বা পানিতে ডুবে মারা গেলে লাশ যেমন হওয়ার কথা, তেমন ছিল না। তাই মেয়েকে হত্যা করে পরে পুকুরে ফেলা হয়েছে, এমনটাই ভাবছেন মামুনুর রশীদ।

দোতলার একটি জানালা থেকে মাছের খাবারের জন্য ভাত ফেলতেন বাড়িওয়ালার পরিবারের সদস্যরা। আফসির লাশ উদ্ধারের পর এক নারী বলেছেন, ওই পুকুরে কিছু একটা ফেলার শব্দ শুনেছিলেন। তখন ভেবেছিলেন হয়তো কেউ ভাত ফেলেছে।

মামুনুর রশীদ ও নুসরাত জাহান দম্পতির ছিল দুই মেয়ে দুই ছেলে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক ছেলের জন্ম হয়েছে। বড় মেয়ের বয়স ১০ বছর, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। এক ছেলের বয়স ৭ বছর, ও পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। আর আফসিকে সামনে স্কুলে ভর্তি করার কথা চিন্তা করছিলেন তাঁরা।

মামুনুর রশীদ বলেন, মেয়েটা নতুন বাড়ি দেখে যেতে পারল না। মামির কেনা শাড়িটা পরতে পারল না। জন্মদিনের কেক খেতে পারল না। ও এখন দাদার কবরের পাশে কবরে শুয়ে আছে।

মেয়েকে নিয়ে মামুনুর রশীদের কত গল্প। বললেন, ‘জানেন, মেয়েটা অনেক বায়না করত। যেদিন নিখোঁজ হলো, সেদিন ছিল শনিবার। মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দাঁত ব্রাশ করতে বললাম। তারপর নিজেই প্যান্ট ও ফ্রক পরিয়ে দোকানে নিয়ে নাশতা কিনে দিলাম। তখনো জানতাম না, এটাই মেয়ের জন্য শেষ নাশতা কেনা।’

মামুনুর রশীদ বললেন, ‘মেয়ের মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। বিচার না পেলে তো মেয়েও আমাকে ক্ষমা করবে না। আমি চাই, যারা আমার মেয়েকে হত্যার সঙ্গে জড়িত, তারা কঠোর শাস্তি পাক। আবার কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে এ মামলায় শাস্তি না পায়, তা–ও চাই।’

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের মধ্যে দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আসামিরা সম্ভবত নেশা করে। স্বর্ণের কানের দুলের জন্য শিশুটিকে হত্যা করা হতে পারে। মামলার তদন্ত চলছে।

মামুনুর রশীদ ‘আফসির খোলাচিঠি’তে লিখেছেন, ‘বাবা, আমি তো শুধু ছোট একটা কানের দুল চেয়েছিলাম...

আমি আফসি—বয়স মাত্র ৪ বছর। আমি চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। আমার নতুন ছোট ভাই এসেছে গত মাসে, আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। আমি ভাবতাম সে একদিন আমাকে “ছোট আপু” বলে ডাকবে। আমি ওর সঙ্গে খেলব, ওকে গল্প শোনাব, ওর চোখে ঘুম নামবে আমার কোলেই। কিন্তু আমি বুঝিনি, পৃথিবী এত নিষ্ঠুর হতে পারে…।’

আফসির হয়ে মামুনুর রশীদ লিখেছেন, ‘আমি তো কিছুই করিনি বাবা…কিন্তু আমার সেই জন্মদিনেই—৬ অক্টোবর, যেদিন কেক খাওয়ার কথা ছিল, সেই দিনেই আমাকে দাফন করা হলো। জন্ম আর মৃত্যু—একই দিনে…। এমন নির্মম কাকতাল পৃথিবী হয়তো খুব কমই দেখেছে।’

খোলাচিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘আমি এখন তোমাদের কাছে নেই বাবা, কিন্তু আমি আছি—তোমাদের চোখে, কান্নায়, প্রতিটি নিশ্বাসে। আমার আত্মা চায়, যারা আমার হাসি কেড়ে নিয়েছে, যারা আমার জীবনের আলো নিভিয়ে দিয়েছে—তাদের যেন এই দেশের আইন কঠোরতম শাস্তি দেয়।’