এ দেশের ছোট্ট পাখিগুলো 

রাজশাহীর বটতলা ঘাটের পাড়ে বটগাছে এ দেশের ক্ষুদ্রতম পাখি ছোট ফুলঝুরির ছানা
ছবি: লেখক

বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখি ‘বি হামিং বার্ড’-এর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ দশমিক ৯ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১ দশমিক ৭৫ গ্রাম। কিন্তু এ দেশের ক্ষুদ্রতম পাখিটির খোঁজ কজনই–বা রাখেন? সংখ্যায় বেশ থাকলেও অত্যন্ত লাজুক পাখিটি সহজে নজরে আসে না। দৈর্ঘ্য ও ওজনে পাখিটি যথাক্রমে মাত্র ৮ সেন্টিমিটার, ওজন ৬ দশমিক ৩ গ্রাম। এ দেশে ওর আরও সাতটি জাতভাই রয়েছে, যারা সবাই ডাইসিইডি গোত্রের সদস্য। এই গোত্রের পাখিগুলো গাঁট্টাগোট্টা; চঞ্চু ছোট ও লেজ খাটো। এরা ফুলঝুরি, ফুলচুষি বা ফুলচুষকি নামে পরিচিত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার আবাসিক পাখিগুলোর বিশ্বব্যাপী প্রজাতিসংখ্যা প্রায় ৫০। এ দেশে আমি ৪টি প্রজাতির দেখা পেয়েছি। ওদের দেখার ঘটনাগুলো সংক্ষেপে বলছি।

এক. লোভনীয় টকটকে লিচুর থোকা ঝুলছে! এমন সময় কোত্থেকে ছোট্ট এক পাখি এসে লিচুর ওপর বসে শৈল্পিক ভঙ্গিতে খোসা ছাড়িয়ে খেতে লাগল। মুহূর্তেই পুরো লিচু সাবাড় করে খয়েরি বিচিটাকে ঝুলিয়ে রেখে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে পাশের লিচুটিতে বসল। এর আগে কোনো দিন এত ছোট্ট পাখি দেখিনি! ২৭ বছর আগে ফকিরহাটের মূলঘর গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছিল। দুই বছর পর কানাডায় গিয়ে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখি হামিং বার্ড’য়ের একটি প্রজাতি দেখেছিলাম; আমার দেখা বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পাখি। মূলঘরে দেখা পাখিটি কিন্তু হামিং বার্ডের চেয়ে খুব বেশি বড় ছিল না। পরবর্তী সময়ে বহুল দৃশ্যমান পাখিটিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুবার দেখেছি। এটিই এ দেশের ক্ষুদ্রতম ছোট পাখি, মেটেচঞ্চু বা টিকেলের ফুলঝুরি (পেইল-বিল্ড বা টিকেল’স ফ্লাওয়ারপেকার)।  

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মান্দারগাছে পুরুষ সিঁদুরে-পিঠ ফুলঝুরি
ছবি: লেখক

দুই. ২০২১ সালের ১০ মার্চ। সকাল ছয়টায় কিছু অদেখা পাখির সন্ধানে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মান্দারগাছের পাশের টাওয়ারে উঠলাম। ক্যামেরা হাতে অবিচল গাছের পানে তাকিয়ে আছি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গেল। এমন সময় টাওয়ারের আলোকচিত্রীদের ক্যামেরাগুলো হঠাৎ যেন গর্জে উঠল! ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। সিঁদুরে লাল-পিঠের ছোট্ট একটি পাখি মান্দারগাছে এসেছে। যদিও ওর ছবি আগে বহুবার তুলেছি, কিন্তু মান্দারের টকটকে লাল ফুলের সঙ্গে ওর ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। এটি এ দেশের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম পাখি সিঁদুরে-পিঠ বা লালপিঠ ফুলঝুরি (স্কারলেট-ব্যাকড ফ্লাওয়ারপেকার)। সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটির দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ৫ থেকে ৯ দশমিক শূন্য সেন্টিমিটার এবং ওজন ৭ থেকে ৮ গ্রাম।

তিন. ১৫ বছর আগে প্রথম ওকে দেখি মালয়েশিয়ার বাটারওর্থের পেনাং বার্ড পার্কে। সেই থেকেই ওকে আমি খুঁজছি এ দেশে, বিশেষভাবে সুন্দরবনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পাইনি। বর্ষার রূপ দেখার জন্য ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সুন্দরবন গেলাম। ট্যুর শেষে ফেরার পথে করমজল নামলাম। কাঠের ট্রেইলের অর্ধেকটা হাঁটার পর একটি বড় গাছের পাশে এসে দাঁড়ালাম। গাছের ছোট্ট ডালে ক্ষুদ্র একটি পাখি এসে বসল। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ক্লিক করতেই চিনে ফেললাম। কমলা পেটের ক্ষুদ্র পাখিটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক ও তৃতীয় ক্ষুদ্রতম পাখি। নাম কমলা-নীল ফুলঝুরি (অরেঞ্জ-বেলিড ফ্লাওয়ারপেকার)। দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৫ দশমিক শূন্য থেকে ৮ দশমিক ৭ গ্রাম। 

চার. ৯ বছর আগের কথা। বিরল ও দুর্লভ পাখির প্রজনন প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণার জন্য রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে এসেছি। কর্ণফুলী নদীর পাড়ঘেঁষা পাহাড়ের ওপর অবস্থিত বন বিভাগের ‘বনফুল’ বাংলোয় উঠেছি। সকালে নাশতা সেরে ক্যামেরা হাতে ছাদে উঠলাম। আশপাশের গাছে প্রচুর ছোট্ট পাখির সমারোহ। দ্রুত কিছু ক্লিক করলাম। একসময় হলদে পেটের ক্ষুদ্র একটি পাখি এসে ছাদের রেলিংয়ে বসল। আগে কখনো দেখিনি পাখিটিকে। শাটারে ক্লিক করতে যাব, এমন সময় ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। ঠিক দুই বছর পর একই প্রজাতির পাখি দেখলাম হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে। তবে বেশ দূরে থাকায় সাক্ষী ছবি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলাম। দুর্লভ আবাসিক পাখিটির নাম হলদে-তলা ফুলঝুরি (ইয়েলো-ভেন্টেড ফ্লাওয়ারপেকার)। দৈর্ঘ্য মাত্র ৯ থেকে ১০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৯ থেকে ১০ গ্রাম।

সুন্দরবনের করমজলে পুরুষ কমলাপেট ফুলঝুরি
ছবি: লেখক

এ দেশের আট প্রজাতির ফুলঝুরির মধ্যে আমার অদেখা চারটি ফুলঝুরিই বিরল। এগুলোর মধ্যে কেউ কেউ নিরল (প্লেইন) ও চঞ্চুমোটা (থিক-বিল্ড) ফুলঝুরির দেখা পেলেও সাম্প্রতিককালে হলদে-পেট (ইয়েলো-বেলিড) ও অগ্নিবুক (ফায়ার-থ্রটেড) ফুলঝুরির দেখা কেউ পেয়েছেন বলে শুনিনি। এদের স্ত্রী ও পুরুষের পালকের রঙে পার্থক্য থাকে। ফলভুক ছোট্ট পাখিগুলো রসাল কীটপতঙ্গও খায়। গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করে। প্রজাতিভেদে জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে প্রজনন করে। সচরাচর উঁচু পাতাবহুল গাছের পরগাছার নিচের দিকে ঘাস, শেওলা ইত্যাদি মাকড়সার জালে জড়িয়ে রাজহাঁসের ডিম বা নাশপাতি আকারের ছোট বাসা বানায়। ডিম পাড়ে দু-তিনটি, যা ১০ থেকে ১৪ দিনে ফোটে। মাত্র ১৫ দিনে ছানারা উড়তে শেখে।   


পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ