আনিসুজ্জামান মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন

১৪ মে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের চতুর্থ প্রয়াণ দিবস। তাঁকে স্মরণ করে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফা। বেঙ্গল শিল্পালয়ের কার্যালয়, ঢাকা, ৬ মে
ছবি: দীপু মালাকার

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কেবল সাহিত্য ও ভাষা নিয়েই কাজ করেননি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর একটি বড় ভূমিকা ছিল। দেশের সব সংকটে তিনি তাঁর স্বভাব অনুযায়ী সেই ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি অসাম্প্রদায়িক জনকল্যাণকর গণতান্ত্রিক মুক্ত সমাজের। সেই লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। দেখিয়েছেন লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে, তাহলেই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।

আজ শনিবার জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্মরণ বক্তৃতায় কথাগুলো বলছিলেন প্রধান বক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফা। তিনি দীর্ঘদিন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সহকর্মী ছিলেন। তাঁর বক্তৃতায় অতীত দিনের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণার পাশাপাশি সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে আনিসুজ্জামানের গবেষণার মূল্যায়নও উঠে আসে।

১৪ মে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের চতুর্থ প্রয়াণ দিবস। ২০২০ সালে তিনি প্রয়াত হন। তাঁকে স্মরণ করে বেঙ্গল শিল্পালয় শনিবার বিকেল পাঁচটায় ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে তাদের কার্যালয়ে এই স্মরণ বক্তৃতা আয়োজন করে।

সূচনা বক্তব্য দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের শীর্ষ গবেষক, আমৃত্যু শিক্ষাব্রতী ধীমান ভাবুক। তাঁর বহুধারার কাজ বাঙালির স্বরূপ অনুসন্ধান ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে। তিনি ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের অন্যতম ট্রাস্টি এবং কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি।

বক্তৃতায় অতীত দিনের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণার পাশাপাশি সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে আনিসুজ্জামানে গবেষণার মূল্যায়নও উঠে আসে। বেঙ্গল শিল্পালয়ের কার্যালয়, ঢাকা, ৬ মে
ছবি: প্রথম আলো

প্রধান বক্তা গোলাম মুস্তাফা বলেন, তাঁর ছিল অসাধারণ পরিমিতিবোধ। কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি বাহুল্য বর্জিত সারকথাটি সুস্পষ্ট করে বলতে পারতেন। কোনো আন্দোলন–সংগ্রামের আলোচনা করতে গেলে আমরা সাধারণত সেখানে নিজেদের ভূমিকাই প্রধান করে তুলি। কিন্তু তিনি নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে মূল ঘটনাকে প্রধান করে তুলতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও সজ্জন।

প্রধান বক্তা বলেন, বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান নিয়ে তিনি যে মূল্যবান গবেষণা করেছেন তার ফলে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তার আগে সাহিত্যের ইতিহাসে মুসলিমদের অবদান ছিল অনুল্লেখিত। ফলে সেই ইতিহাস ছিল খণ্ডিত। এই অসম্পূর্ণতা দূর করাই ছিল তার গবেষণার লক্ষ্য। তা ছাড়া তিনি ১৭৭৪ থেকে ১৮১৪ সালের ৪ হাজারের বেশি চিঠিপত্র ও মামলার দলিল সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে থেকে বাংলা গদ্যের উদ্ভব বলে যে ধারণাটি প্রচলিত রয়েছে, তার অনেক আগে থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত গদ্যে বাংলা লেখার চল ছিল। বরং অনেকাংশে ফোর্ট উইলিয়ামের গদ্যই সে তুলনায় আড়ষ্ট ছিল। তাঁর এই গবেষণা অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি পুরোনো দিনের বাংলা গদ্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও অর্থনীতির ভূমিকাও তুলে এনেছেন। একই সঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভাবাদর্শ ও সৃজনশীলতার সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে যে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন সেটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আলোচনা করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বেঙ্গল শিল্পালয়ের কার্যালয়, ঢাকা, ৬ মে
ছবি: প্রথম আলো

মূল বক্তৃতার পরে আলোচনা করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আনিসুজ্জামান সব সময় জীবন বোধে ছিলেন সমসাময়িক। সক্রিয় চিন্তাবিদ। অনেক চিন্তাবিদ আছেন, যাদের কাজের সঙ্গে সরাসরি জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু তিনি তাঁর চিন্তা ও কর্মকে এমন করে সাজিয়েছেন যা মানুষের কাজে আসতে পারে।

সভাপতির বক্তব্যে কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া বলেন, সাহিত্যের অধ্যাপনা ও গবেষণা ছাড়াও মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের ইতিহাসের প্রধান ঘটনাগুলোতে আনিসুজ্জামান প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন। দেশের সংবিধান রচনায় তাঁর ভূমিকা ছিল। মুসলিম সাহিত্যিকদের অবদান নিয়ে গবেষণা করলেও তিনি ছিলেন মুক্তমনের মানুষ। ইতিহাসকে দেখেছেন উদার দৃষ্টিতে। যুক্তির বিচারে বিশ্লেষণ করে সত্যকে গ্রহণ করেছেন। মানুষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর ভালোবাসা, তাঁর বহুমুখী কাজ ও এই গুণগুলো আমরা ভুলতে পারব না।

অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছোট মেয়ে শুচিতা জামানের অকালপ্রয়াণে গভীর শোক, তাঁর আত্মার শান্তি ও পরিবারে প্রতি সমবেদনা জানানো হয়।

আলোচনা পর্ব শেষে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনান বিশিষ্ট শিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ান।