আওয়ামী লীগের নেতাদের ক্ষোভ সভাপতির বিরুদ্ধে, এখনো এলোমেলো বিএনপি

জেলা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও জেলা ছাত্রলীগ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে।

পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০২২ সালের মার্চে। বর্তমান রেলমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) নূরুল ইসলাম (সুজন) সভাপতি হন। সম্পাদক হন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কমিটিতে স্বজনতোষণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো হালনাগাদ করতে না পারার অভিযোগ করেছেন নেতা-কর্মীরা।

সদর ও আটোয়ারী ছাড়া অন্য তিনটি উপজেলা এবং পঞ্চগড় পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। জেলা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ ও জেলা ছাত্রলীগ মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে।

অপর দিকে, জেলা বিএনপি এখন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দলীয় কোন্দলে একসময় পৃথক কর্মসূচি পালন করা পঞ্চগড় জেলা বিএনপির নেতাদের সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে একই মঞ্চে দেখা গেছে। তবে পঞ্চগড় পৌরসভা ও পাঁচ উপজেলায় বিএনপির হালনাগাদ কমিটি না থাকায় কর্মসূচি পালনের বিষয়ে হতাশা রয়েছে অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে।

আওয়ামী লীগে মন্ত্রীর দাপট

নূরুল ইসলাম ও আনোয়ার সাদাত নেতৃত্বে আসার পর তাঁদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তাঁরা বিভিন্ন কমিটিতে পরিবারের লোকজনকে পদ দিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়েছেন। এ ছাড়া অধিকাংশ কমিটি তাঁরা হালনাগাদ করতে পারেননি। জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নূরুল ইসলাম নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক মিলে আত্মীয়করণ কমিটি বানিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা দুজন মিলে তাঁদের পরিবারের অন্তত ২৪ জনকে কমিটিতে রেখেছেন। আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম, অথচ আমাকে এবারের কমিটির কোনো পদে রাখা হয়নি। আমার বড় ভাই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। সেই নির্বাচনে নূরুল ইসলাম ও আনোয়ার সাদাত আমার বড় ভাইয়ের বিরোধিতা করে হারিয়েছিলেন। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম তাঁর ছেলে, ভাই, ভাগনিসহ ১০ থেকে ১২ জন স্বজনকে জেলা কমিটিতে ঢুকিয়েছেন। এমনকি পাঁচ বছরে নিজ সংসদীয় এলাকার বাইরের একটা ছেলেমেয়েকেও রেলে চাকরি দেননি।’

রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ পঞ্চগড়-১ (সদর, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া) আসনের সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধানের। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জেলা কমিটি ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল সভাপতি, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করবেন।

কিন্তু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার সময় আমাকে একবারের জন্যও জানাননি বা পরামর্শ নেননি। দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মিলে আত্মীয়করণ কমিটি করেছেন। গত প্রায় পাঁচ বছরে রেলমন্ত্রী পঞ্চগড়-১ আসনের কোনো লোককে চাকরি দেননি।’

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে রেলমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

জেলার পাঁচ উপজেলার মধ্যে সদর ও আটোয়ারী ছাড়া অন্য তিনটি উপজেলা এবং পঞ্চগড় পৌর আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। আট সহযোগী সংগঠনের মধ্যে কেবল কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ও মৎস্যজীবী লীগের কমিটি হালনাগাদ রয়েছে। ১০ বছরের পুরোনো সেই আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে যুবলীগ। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের শেষ কমিটি হয়েছে পাঁচ বছর আগে। মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটি ছয় বছর আগের। যুব মহিলা লীগের কমিটি ৯ বছরের পুরোনো। আর জেলা ছাত্রলীগের এক বছর মেয়াদি আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত বলেন, ‘এই মুহূর্তে কোনো সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের বিষয় জরুরি নয়। এখন সব কর্মসূচিই আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক। নির্বাচনের পর নতুন করে দল গোছানো হবে।’

এদিকে সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিভক্ত হয়ে পৃথকভাবে পালন করছেন নানা কর্মসূচি। পঞ্চগড়-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধান আবারও মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দুবার সংসদ সদস্য থাকাকালে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়াইনি। কারও সঙ্গে কোনো অন্যায় করিনি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আশা করি, জননেত্রী শেখ হাসিনা এবারও আমাকে এই আসনে মনোনয়ন দেবেন।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাতও এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি সার্বক্ষণিক জনগণের সঙ্গেই মিশে আছেন বলে দাবি করেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাঈমুজ্জামান, আবু তোয়বুর রহমান, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আবদুল লতিফ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম, আটোয়ারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আটোয়ারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম এবং তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইয়াসিন আলী মণ্ডলও দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে নানাভাবে জানান দিচ্ছেন।

পঞ্চগড়-২ আসনে রেলমন্ত্রীর পাশাপাশি দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক চিশতী দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন।

বিএনপির চিন্তায় এক দফার আন্দোলন

২০০৯ সালে সাবেক সংসদ সদস্য মোজাহার হোসেনকে সভাপতি ও নাজমুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়েছিল। ২০১১ সালে নাজমুল হকের মৃত্যু হলে জেলা বিএনপি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। ২০১৪ সালে এ হাসান প্রধানকে আহ্বায়ক এবং এম এ মজিদকে সদস্যসচিব করে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। যথাসময়ে সম্মেলন করতে না পারায় ওই কমিটি বিলুপ্ত হলে দীর্ঘদিন নেতৃত্বশূন্যতায় ছিল জেলা বিএনপি। এরপর ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট জাহিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও ফরহাদ হোসেনকে সদস্যসচিব করে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। প্রায় চার বছরের পুরোনো ওই আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে পঞ্চগড় জেলা বিএনপি।

জেলার পাঁচটি উপজেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই আহ্বায়ক কমিটি এখনো চলছে। পঞ্চগড় পৌর বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৯ সালে। এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার ও তৌহিদুল ইসলামের দ্বন্দ্বে কোনো সম্মেলন হয়নি। জেলার আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু জেলা শহর হওয়ায় পঞ্চগড় পৌর বিএনপির হালনাগাদ কমিটি থাকা জরুরি বলে মনে করছেন নেতা-কর্মীরা।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের কাছে এক দফার আন্দোলনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বর্তমানে ভোটাররা বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন।’

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে পঞ্চগড়-১ আসনে কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নওশাদ জমিরই প্রার্থী হতে পারেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। ২০১৮ সালেও তিনি প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও পৌর বিএনপির সভাপতি তৌহিদুল ইসলামের নাম আছে আলোচনায়।

পঞ্চগড়-২ আসনে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব ও কেন্দ্রীয় পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন প্রার্থী হতে পারেন। ২০১৮ সালে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য মোজাহার হোসেনের ছেলে মাহমুদ হোসেন মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানিয়েছেন।

আরও তিন দলে প্রার্থীদের তোড়জোড়

২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের স্বার্থে পঞ্চগড়-১ আসনটি জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে জাপার প্রার্থী ছিলেন জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক।

তিনি মহাজোটের প্রার্থী হয়েও পরাজিত হন জোটের আরেক দল জাসদের (ইনু) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হক প্রধানের কাছে। ২০১৮ সালে আবু সালেক মনোনয়ন দাখিল করলেও প্রচারণার শেষ দিনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এবারও আবু সালেক জাপার প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন। পঞ্চগড়-২ আসনে বোদা উপজেলা জাপার সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে।

জাসদ ভেঙে গঠন করা বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া-নাজমুল) পঞ্চগড়ে তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পঞ্চগড়-১ আসনে প্রার্থী হবেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান। পঞ্চগড়-২ আসনে দলটির পঞ্চগড় জেলা শাখার সভাপতি এমরান আল আমিন প্রার্থী হতে পারেন।