বর্ষাযাপনে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের সঙ্গে যা প্রিয় বাঙালিদের
বাঙালি যেমন বৃষ্টিবিলাসী, তেমন ভোজনরসিকও বটে। তাই হয়তো বর্ষাযাপনে বৃষ্টিতে ভিজে বৃষ্টিবিলাসের চেয়ে এমন ঘনঘোর বরিষায় কী খাওয়া যায়—সেটিও থাকে তাঁদের অন্যতম ভাবনা। বর্ষায় খিচুড়ি আর ইলিশের কদর তো রয়েছেই, কিন্তু বৃষ্টিমুখর দিনে চা এবং চায়ের সঙ্গে নানা ধরনের খাবার—বলা যায় বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে গেছে। এই সময়ে হরেক ধরনের চা দেখা গেলেও আদা দিয়ে র-চা, দুধ-চা আর গুড়ের চা নিয়েই বাঙালিদের আদিখ্যেতা বেশি। যেহেতু বাঙালিরা একটুখানি আয়েশি, তাই শুধু চা দিয়ে তাঁদের হয় না। চায়ের সঙ্গে অবশ্যই কিছু থাকা চাই।
এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভাজাপোড়াজাতীয় নানা খাবার। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো পেঁয়াজু। এটি পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ আর মসুর ডালের মিশেলে তৈরি করে কড়কড়ে করে ভেজে নেওয়া হয়। পেঁয়াজু যেন ছোটখাটো একেকটি সুখের টুকরো! সঙ্গে যদি থাকে গরম বেগুনি, তাহলে তো কথাই নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন ডালের বড়া, আলুর চপ, ডিমের চপ, মচমচে শিঙাড়া কিংবা সমুচাও কিন্তু বাঙালিদের বর্ষাদিনের চায়ের টেবিলে জায়গা করে নেয় অনায়াসে।
এসব ছাড়াও ভাজাপোড়ার তালিকায় পাকোড়ার কথা ভুলে গেলে চলবে না। বর্ষাযাপনে পাকোড়া যেন একটি আবেগ। আর ঘরে যা আছে, তাই দিয়ে বেসনের মিশ্রণে মেখে ডুবোতেলে দিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যায় মচমচে পাকোড়া। কখনো আলু, কখনো পাউরুটি, কখনো পেঁয়াজ, কখনো শাপলার ডাঁটা, কখনো বা ধনেপাতা আর কাঁচা মরিচ—যে উপকরণই থাকুক না কেন, বৃষ্টির দিনে গরম চায়ের সঙ্গে পাকোড়ার স্বাদ অতুলনীয়। আর যদি থাকে টক-ঝাল কোনো চাটনি বা টমেটো সস, তবে আর কী চাই! বৃষ্টির দিনে চায়ের সঙ্গে গরম পাকোড়াই বাঙালিদের অন্যতম সহজ এবং প্রিয় খাবার।
আবার অনেকেই বৃষ্টির দিনে চায়ের সঙ্গে খেতে পছন্দ করেন মুড়ি মাখা। বৃষ্টিস্নাত বিকেলে সবাই মিলে একসঙ্গে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে মুড়ি মাখা খাওয়ার মজা সত্যিই আলাদা। এমন দিনে চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা আর শর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখা মানেই যেন উৎসব। তবে বৃষ্টি এলে চিড়েভাজা আর চালভাজারও কিন্তু রয়েছে আলাদা একটি আমেজ। চালে একটু লবণ দিয়ে ভেজে এতে শর্ষের তেল, পেঁয়াজ, আদাকুচি আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখিয়ে নিলেই চা দিয়ে খাওয়ার মতো তৈরি হয়ে যায় এক ‘অমৃত’। শর্ষের তেল আর আদাকুচির জন্য এতে যে ঘ্রাণ আসে, তাতে জিবে একে অন্যরকম স্বাদ এনে দেয়।
তবে বর্তমানে চিরচেনা পেঁয়াজু-বেগুনি, চালভাজা আর চিড়েভাজার বাইরে শহুরে চা-আড্ডায় জায়গা করে নিয়েছে নতুন ও ট্রেন্ডি কিছু খাবার। বর্তমানে অনেকেই বর্ষার দিনে এক কাপ ইস্পাহানি মির্জাপুর চায়ের সঙ্গে খেতে পছন্দ করেন স্টিমড মোমো, ঝাল নুডলস, হট অ্যান্ড সাওয়ার স্যুপ কিংবা কোরিয়ান রামেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে এগুলো বেশ জনপ্রিয়। এসব খাবার সাধারণত শহরের ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টে পাওয়া গেলেও অনেকেই এখন ঘরেই ঝটপট রেডি নুডলস, রামেন বা মোমো তৈরি করে ফেলেন বর্ষার সন্ধ্যায়। সয়া সস, চিলি ফ্লেক্স, তিলের তেল বা গার্লিক সস দিয়ে পরিবেশন করা এই খাবারগুলো চায়ের সঙ্গে দেয় এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
বর্ষার সময়টা তাই শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, একান্ত নিজের হয়ে ওঠার মুহূর্তও বটে। চায়ের কাপ আর তার পাশে সাজানো খাবারগুলো যেন একেকটি গল্প বলে—শৈশবের স্মৃতি, পরিবারের সঙ্গে আড্ডা, বন্ধুদের হাসি কিংবা নিঃসঙ্গ কোনো বিকেলের দীর্ঘশ্বাস। সব মিলিয়ে বর্ষা যেন হয়ে ওঠে একটি পরিপূর্ণ উৎসব। সময় বদলালেও এই উৎসবের রূপ বদলায় না, চায়ের টেবিল ঘিরে বাঙালির ভালোবাসা ঠিক একই থেকে যায়—আবেগে ভরপুর, আন্তরিক আর চিরচেনা।