আকবর আলি খান হতে পারেন আমলাদের অনুপ্রেরণার প্রতীক

আকবর আলি খান (১৯৪৪—৮ সেপ্টেম্বর ২০২২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম।

প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পর অবসরে গিয়ে আকবর আলি খান যেভাবে লেখালেখি করেছেন এবং দেশ ও মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, তা ছিল বিরল। তাঁর এই কর্মতৎপরতা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে। তিনি হতে পারেন অনেকের অনুপ্রেরণা। এভাবেই প্রয়াত লেখক, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের কর্মজীবনের মূল্যায়ন করেছেন তাঁর সাবেক সহকর্মী ও গুণীজনেরা।

আজ সোমবার ‘ড. আকবর আলি খান: বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজে তার অবদান’ শিরোনামে একটি ওয়েবিনারে যুক্ত হয়ে  আকবর আলি খানের সাবেক সহকর্মী ও গুণীজনেরা এই মূল্যায়ন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক, সাবেক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ওয়েবিনারে বক্তব্য দেন। সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আকবর আলি খানের অনেক পরিচয়। তিনি আমলা, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর হারিয়ে যাননি। সমকালীন বিষয়ে কথা বলেছেন। লেখালেখি করেছেন। প্রশাসনে এমন কতজন কর্মকর্তা রয়েছেন সে প্রশ্ন রেখে দেবপ্রিয় বলেন, চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর যাতে কর্মকর্তারা হারিয়ে না যান, সে জন্য তাঁরা আকবর আলি খান থেকে অনুপ্রেরণা নেবেন।

সংকটকালে রাজনৈতিক উত্তরণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে আকবর আলি খান যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তা স্মরণ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে আকবর আলি খানসহ চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছিলেন। ওই সময় তাঁরা যদি পদত্যাগ না করতেন, তাহলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিষয়টি হয়তো ভিন্ন হতো।

আকবর আলি খানের ওই অবদান ইতিহাসে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, তাঁর ওই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে বর্তমান ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তি। সেই শক্তি উপদেষ্টাদের জন্য কিছু করেনি। এ ছাড়া আকবর আলি খানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনো শোক প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, যা ছিল দুঃখজনক।

আলোচনায় আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, ছাত্রজীবনে আকবর আলি খানের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হলের কক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে। তাঁর কক্ষে বই ছাড়া হাঁটা–চলার জায়গা ছিল না। চাকরিজীবনেও তিনি সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও অর্থ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রিপরিষদের সচিবও ছিলেন। আর এসব দায়িত্ব তিনি একটি রাজনৈতিক দলের সময় নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে পালন করেছেন। তবে তিনি চাকরি জীবনে যতটা পরিচিত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন অবসরের পরে লেখালেখি করে। আবদুল মুয়ীদ বলেন, আমলাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজেদের রং বদলে সব সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারা। কিন্তু আকবর আলি খান তাঁর রং বদলাননি।

আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, এমন কোনো বিষয় ছিল না যেখানে আকবর আলি খান কাজ করেননি। ১০০ বছর পর কেউ যদি তাঁকে স্মরণ করেন, সেটি তাঁর লেখা বইয়ের জন্য করবেন। তিনি বিশ্বব্যাংকে কাজ করেছেন, নাকি অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন, মানুষের ততটা মনে থাকবে না। তাঁকে স্মরণ করবেন বইয়ের জন্য।

মোহাম্মদ তারেক বলেন, ‘“ডিসকভারি অব বাংলাদেশ’’ বইয়ের জন্যই আকবর আলি খান ১০০ বছর বেঁচে থাকবেন। বইটি মানুষ আজীবন মনে রাখবে।’

কর্মজীবনের স্মৃতিচারণা করে সাবেক অতিরিক্ত সচিব আফতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে রাগারাগি করতেন। কিন্তু আকবর আলি খান কখনো উচ্চবাচ্য করেননি। কোনো কিছু সংশোধনের প্রয়োজন হলে তিনি নিজেই করে দিতেন। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার প্রতীক।’

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, অনেকে মনে করেন আমলাদের পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমলাদের পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আকবর আলি খান প্রমাণ করেছেন, এসব ঠিক নয়। তিনি আমাদের আদর্শ।